মাইনরিটি মিউজিয়াম

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-০২ ২২:৩২:৩২

মাসকাওয়াথ আহসান:

২০২৫ সাল। উন্নয়নের আলোর স্পর্শে স্বর্ণভূমি ঝলসে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন আসে, অধিক ক্যালরির খাদ্য গ্রহণের কারণে বেশীর ভাগ স্বর্ণপুরবাসী মেদ-ভুড়ি কী করি সমস্যায় নিপতিত হয়েছে। স্বর্ণপুরে আকাশ ছোয়া বুর্জ-এ-মজিদ স্থাপত্য চোখে পড়ে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ দালান। শহরে কোন যানজট নেই। বেশীর ভাগ মানুষই উড়ন্ত গাড়ীতে চলাফেরা করে। এতে অবশ্য সমস্যা কিছু হচ্ছে। উড়ন্ত গাড়ীতে ঠোকাঠুকির কারণে দরিদ্র রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের সিএনএন টিভি একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে’ “অলৌকিক ধাক্কানগরী”।

এটাকে স্বর্ণভূমির বিশিষ্ট মজিদজীবীরা একটি ভ্রান্ত প্রচারণা বলে মনে করেন। স্বর্ণপুরীর শীর্ষ মিডিয়া লালসালুডটকম সিএনএন-এর বিরুদ্ধে তাদের বহুল ব্যবহৃত ‘হলুদ’ কমলার ছিলকা ছুড়ে দেয়। হলুদ ছিলকাটা ধরে নিয়ে বুর্জ-এ-মজিদের খাদেমেরা গণমামলা ঠুকে দেয় সিএনএন-এর বিরুদ্ধে।

দেশের শীর্ষ নেতা বলেন, আমাদের জিডিপির হার ১০ শতাংশ, আমরা দেশপ্রেম ও বিদ্যুৎ উতপাদনের রেকর্ড করেছি। কেউ না খেয়ে নেই বরং বিরিয়ানী-বার্গার খেয়ে মোটা হয়ে গেছে। এইজন্য গরীব দেশ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। উড়ন্ত গাড়ীর ঠোকাঠুকি মিডিয়ার সৃষ্টি। আমার সরকারের বদনাম করতেই এই সুগভীর ষড়যন্ত্র; একে আমরা নস্যাত করে দেবো। প্রয়োজনে বাঘের থাবা দেবো।

স্বর্ণভূমিতে ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে আসার জন্য নাসার লোকেরা পর্যন্ত আবেদন করে। কিন্তু ওয়াশিংটনের স্বর্ণভূমি দূতাবাস প্রত্যাখ্যান করে সেসব আবেদন। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু কুচক্রী রাষ্ট্র; একজন স্বর্ণভূমি বংশোদ্ভুত এমেরিকান রিপোর্টার কোন মতে স্বর্ণভূমিতে পাঠিয়ে দেয়।

স্বর্ণভূমির বিমান মাজারে নেমে চোখ ঝলসে যায় দরিদ্র রিপোর্টারটির। কী এক জৌলুসের রুপকথার রাজ্য! একজন সহৃদয় পুলিশ কর্মকর্তাকে অনুনয় বিনয় করে, এই স্বর্ণনগরীতে প্লাটিনাম কার্ড ছাড়া আর কোন কার্ড কোন আবাসিক হোটেল একসেপ্ট করেনা। কম খরচে থাকার কোন হোটেল কী পাওয়া যাবে!

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দারিদ্র্যকে আমরা এখনো জাদুঘরে পাঠাতে পারিনি। তাই একটি পাতাল শহর তৈরী করেছি আমরা। ঐখানে আপনার মত দরিদ্রদের রেখেছি আমরা। আপনি রেলস্টেশানে গেলে পাতাল শহরের নিম্নগামী সিঁড়ি পেয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ দিয়ে রিপোর্টার পাতাল নগরীতে চলে যায়। থাকার হোটেলও পেয়ে যায়। মানুষগুলোও খুব আতিথেয়তা প্রবণ। মনের দিক দিয়ে ধনী লোকেরাই পাতাল নগরে বসবাস করে। সেখানে একজন স্কুল শিক্ষককে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করে, স্যার নগরীতে এমন আকাশ-পাতাল ব্যবধান তৈরী হলো কীভাবে!

--ছাত্রজীবনে যারা উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি গাইডবুক মুখস্ত করেছিলো তারাই উচ্চনগরীতে থাকে। আর আমরা যারা পুরো গ্রন্থ হৃদয়োঙ্গমে ব্যস্ত ছিলাম; তারা খেয়াল করিনি আমাদের বন্ধুরাই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে একটি উচ্চনগরী গড়েছে।

--স্বর্ণভূমির এই উচ্চনগরী-নিম্ননগরী বিভাজন ছাড়া আর কোন বিভাজন আছে!

--আপনি একটু উচ্চনগরীর মাইনরিটি মিউজিয়ামে গিয়ে ওখানে বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা বললে হয়তো বুঝতে পারবেন কী করে এই সফল রাজ্যের অযুত সাফল্য নির্মিত হলো। তারপর আবার পাতাল নগরীতে ফিরে এসে এখানকার অন্যধর্মের মানুষের সঙ্গে কথা বললেই সাফল্যের প্যারাডক্স আপনার কাছে স্পষ্ট হবে।

রিপোর্টার দেরী না করে সকাল সকাল মাইনরিটি মিউজিয়ামে যায়। কিন্তু সবাই খুব ব্যস্ত। রিপোর্টার খুব অবাক হয়ে এলাকার একটি  কফি শপে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে। কফি শপটিও খুব ব্যস্ত। শেষে কবি কবি চেহারার এক ভদ্রলোককে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করে, এখানে সবাই এতো ব্যস্ত কেন!

ভদ্রলোক চিলতে হাসি দিয়ে বলেন, স্বর্ণভূমিটি যেহেতু চেতনায় অসাম্প্রদায়িক; মাইনরিটি মিউজিয়ামের একদল লোক ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ও মিডিয়ায় গীতা-বাইবেল-ত্রিপিটক পাঠে। আবার ধরুন শিল্প-সংস্কৃতির জগতে কিংবা মিডিয়ায় সারাক্ষণ তাদের হাজিরা দিতে হয়। আবার তাদেরকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-আমলা-পুলিশের সঙ্গে বাধ্যতামূলক সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে হয়। ফলে ভীষণ ব্যস্ত সবাই। অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ চন্দ্রে না পাক; জ্যোতস্নায় পাক সামান্য ঠায়।

--তো এতোই যখন অসাম্প্রদায়িক জ্যোতস্নার আলোর চাহিদা; তাহলে আর আলাদা করে মাইনরিটি মিউজিয়াম কেন!

--এটা “একমত একদেশ”; সুতরাং আমাকে প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। কফি খাবেন! খুব আগ্রহ হলে বুর্জ এ মজিদের খাদেম ঐ মজিদ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

রিপোর্টার উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে।

কফিশপে যে রাজনৈতিক নেতা আজ সেলফি কর্মসুচিতে এসেছেন সেই মজিদ ভাইয়াকে রিপোর্টার গিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই যে আপনার মাঝে মাইনরিটির প্রতি এই যে নিখাদ ভালোবাসা; তাহলে এদেশে মাইনরিটি মিউজিয়াম কেন!

--আমরা চেয়েছি অন্যধর্মের মানুষকে একটি নিরাপদ এলাকা গড়ে দিতে। আপনি একে মিউজিয়াম বলছেন কেন! আপনার উদ্দেশ্য কী!

--সরি ভুল হয়ে গেছে বড় ভাই।

রিপোর্টার বুঝতে পারেনা সবাই এই জায়গাটাকে মাইনরিটি মিউজিয়াম বলছে। অথচ বড় ভাই বলছেন নিরাপদ এলাকা!

রিপোর্টার শেষ পর্যন্ত তার বাবার বন্ধু একজন মন্ত্রীর বাসায় যায়। মন্ত্রী অশ্রুসিক্ত হয়ে রিপোর্টারকে জড়িয়ে ধরেন।

--তোমার মনে আছে বাবা তুমি যখন খুব ছোট ছিলে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

---খুব ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে।

রিপোর্টার খুব অবাক হয়; স্বর্ণনগরীতে এই মন্ত্রী ভদ্রলোক এতো সাদাসিধে জীবন যাপন করেন কীভাবে!

মন্ত্রীর লাইব্রেরী রুমে অসংখ্য বই-পুস্তক। মন্ত্রী বলেন, তোমার বাবার সবকটি বই আমার কালেকশানে আছে।

রিপোর্টারকে মন্ত্রী বলেন, তুমি আমার বাসায় ওঠো। আমার বাসা থাকতে তুমি হোটেলে থাকবে কেন!

--চাচ্চু স্বর্ণনগরীতে আপনি এতো সাদাসিধে জীবন যাপন করেন কেন!

--বাবা গায়ে খেটে সতভাবে অনেক অর্থ উপার্জন করেছি আমি। সেগুলো আমি পাতাল নগরীতে বিতরণ করেছি। এখন কাজ আর বইপড়া এই দুই নিয়ে দিব্যি জীবন কেটে যাচ্ছে।

রিপোর্টার আবার অবাক হয়। সাহস করে জিজ্ঞেস করে, চাচ্চু আপনার মতো মানুষ যে দেশে আছে; সেখানে এমন উচ্চনগর-নিম্ননগর কীভাবে হলো!

মন্ত্রী বলেন, এইতো বাবা যে কটাদিন বেঁচে আছি এই বিভেদ কমানোর জন্য কাজ করবো। ছোট্ট সামর্থ্যে যতদূর পারা যায়।

রিপোর্টারের মনে হয়, মাইনরিটি মিউজিয়ামের মতই মন্ত্রী হয়তো অনেস্টি মিউজিয়ামের লোক।

মন্ত্রী রিপোর্টারকে বলেন, তুমি যে অন্তহীন প্রশ্নের গোলকধাধায় ঘুরপাক খাচ্ছো আমিও সেই অন্তহীন প্রশ্নের অগ্নিগোলকধাধায় আটকে আছি। আমি  গোলকধাধায় প্রবেশের পথটা জানতাম; বের হবার পথ খুঁজে পাইনি।

রিপোর্টার বিদায় নেয়। মন্ত্রী একজন নেতার আত্মজীবনীর একটি ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ উপহার দেন। বলেন, এটা পড়ে বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে ঐ নেতার রাষ্ট্র ও মানুষ ভাবনার যে পার্থক্যটুকু খুঁজে পাবে; ওটাই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর।

রিপোর্টার হোটেল কক্ষে এসে বইটি পড়ে। ভালো লাগায় মন শিহরিত হয়। বাবার কাছে এই নেতার কথা অনেক শুনেছে সে। এই সোনার মানুষটির কথাগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে নকল সোনার শহর গড়েছে মজিদেরা সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারে। স্বর্ণভূমি বংশোদ্ভুত হয়েও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তীব্র বেদনাহত হয় রিপোর্টার। এই সোনার মানুষটির হত্যার পিছে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন ছিলো সেটা তো ইতিহাস থেকে মুছে দেয়া যাবে না।

পাতাল নগরে অন্য ধর্মের মানুষের এলাকায় গিয়ে রিপোর্টার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানায় তাদের এলাকাটিও মাইনরিটি মিউজিয়াম। যেহেতু তাদের পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পশ্চিমের দেশে থাকে, গবেষণা-টবেষণা করে; কে কখন নোবেল পুরস্কার টুরস্কার পেয়ে যায়; তখন পরিবারকে ঘাড়ে নিয়ে অন ক্যামেরা নাচতে হবে; তাই সরকার স্বর্ণভূমির এই অন্যধর্মের মানুষগুলোকে পাতাল শহরে রেখেছে।

প্রথম যে স্কুল মাস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো; যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে যায় রিপোর্টার। ভদ্রলোক বলেন, ছোট বেলায় খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প পড়েছিলাম; ঐ গল্পের দৌড়ে কচ্ছপ জিতে গিয়েছিলো। আমরা এই নিম্ন নগরের মানুষেরা সে গল্পে বিভ্রান্ত পরাজিত কচ্ছপ। উচ্চনগরী শাসন করে গল্পের খরগোশেরা; গল্পের মতই ঘুমায় তারা; কিন্তু জিতে যায় নখ-দন্তে ক্ষিপ্রতা থাকায়।

রিপোর্টার জিজ্ঞেস করে, এই খরগোশদের সর্বোচ্চ ভবনটিকে বুর্জ এ মজিদ কেন বলা হয় টিচার।

শিক্ষক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ উপহার হিসেবে দেবার জন্য সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।

রিপোর্টার বিমান মাজারে ও প্লেনে বসে বসে উপন্যাসটি পড়ে। প্লেন টেক অফ করার মুহূর্তে “শস্যের চেয়ে টুপি বেশী, ধর্মের আগাছা বেশী” লাইনটি অভিভূত করে তাকে। প্লেনের জানালা দিয়ে নীচে তাকাতেই বিমান মাজার সন্নিবর্তী এলাকায় সারি সারি টুপি চোখে পড়ে। আর বুর্জ এ মজিদের সাফল্যের পেছনের গল্পটি বুঝতে এতোটুকু অসুবিধা হয়না রিপোর্টারের।  

আপনার মন্তব্য