দেহি মে...

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-০৫ ২০:৫৩:৪৫

 আপডেট: ২০১৬-০৩-০৫ ২০:৫৯:০১

বিতান সিকদার:

আচ্ছা, এটা অনেকটা ফাটা বাঁশে...

না না, একেবারেই নয়। এটা ফাঁকা টানেলে মেট্রো আটকানো। সিম্পল!

অ, আমি ভাবলাম বুঝি...

না, কোনও আদিরসাত্মক কনোটেশন এর সঙ্গে যায় না। মাঝে মাঝেই এরকম আটকায়। এক্ষুণি চালু হয়ে যাবে।

না তা তো হবেই। তবু...মানে ভাবছিলাম, এই যে একটা ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা...

এটা বলতে পারেন। কারণ, এই মুহূর্তে আমরা না শোভাবাজার উঠতে পারব, না শ্যামবাজার উঠতে পারব। মাঝামাঝি জায়গায় তেরচা মেরে দাঁড়িয়ে আছি। তবে এর সঙ্গে ফাটা বাঁশ বা অণ্ডকোষের বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই।

আপনার বাংলাটা কিন্তু বেশ...কেমন সুন্দর ইয়ে না বলে অণ্ডকোষ বলে চালিয়ে দিলেন।

বলছেন?

আলবৎ! একেবারে ইয়ং বেঙ্গল! দৃপ্ত চলন দৃপ্ত বলন...

আর সেই একই দৃপ্ততার সঙ্গে মেট্রো রেলে টানেলের মাঝে আটকে থাকন!

বলন-এর সঙ্গে থাকন কতটা যায় – তা নিয়ে ধন্দ থাকলেও, আপনি যে গভীর কোনও চিন্তন-এ আচ্ছন্ন – সেটা কিন্তু আন্দাজ করাই যাচ্ছে।

...আচ্ছা! কী করে বুঝলেন?

সেই রবীন্দ্রসদন থেকে দেখছি – ময়দানে সামনের সিটটা ফাঁকা হয়ে গেলেও বসলেন না। অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

...তাতে কী! এমনও তো হতে পারত যে আমি পরের স্টেশনে নামব। তাই আর বসিনি।

হতেই পারত। কিন্তু সেক্ষেত্রে পাশে দাঁড়ান লোকটা ফাঁকা সিটে বসে পড়ার পর হঠাৎ করে আপনার মুখের ভাব ‘এ হে ফসকে গেল’...এমনটা হত না। আসলে বেখেয়ালি হয়ে ছিলেন।

...বাহ্, বেশ বললেন তো। আর আর...

আর ধরুন, পার্ক স্ট্রিট থেকে শুরু করে প্রায় সেন্ট্রাল পর্যন্ত ঝুলতে থাকা হাতলটার দিকে ঠায় চেয়ে রইলেন। আসলে তাকিয়েছিলেন ওই দিকে, কিন্তু ভাবছিলেন অন্য কিছু।

...অভূতপূর্ব!

তারপর মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে দাঁতে নখ কাটা শুরু করেছেন। তর্জনি মধ্যমা শেষ করে অনামিকার দিকে দাঁত বাড়াচ্ছিলেন কী...

কী...

এই যে, ফাটা বাঁশ!

আরেহ্, আপনার...

...পর্যবেক্ষণী ক্ষমতা দারুণ তো? আসলে কী জানেন, বুড়ো হয়েছি তো...চারপাশ দেখা ছাড়া ইদানীং আর কিছু কাজ পাই না। যাক গে...তা আপনার চিন্তার বিষয়টা কী?

আজ্ঞে?

বলছিলাম, এই জোয়ান বয়েসে অত কী ভাবছেন মশাই? মানে...এখন তো নামারও উপায় নেই, কিছু করার মতন অবস্থাও নয়। কখন ট্রেন চলবে, তাও ছাতার মাথা বুঝতে পারছি না। তাই ভাবছিলাম – আসুন না, একটু খেউর করি!

বলছেন?

নিশ্চয়ই!

তাহলে শুনুন, আমার চিন্তাটা মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিটাকে নিয়ে। বুঝলেন কিছু?

কথা হচ্ছে সরস্বতী পুজোর কথা বলছেন, এটুকু আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু মাঘ তো বেশ কয়েক মাস আগে ছাড়িয়ে এসেছেন মশাই...

রেশটা রয়ে গেছে।

কিছু ঘটেছিল?

...শুনুন তাহলে। এটা নিশ্চয়ই জানেন যে সরস্বতী পুজোর দিন পুরুতের প্রচণ্ড ক্রাইসিস চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাস্তা থেকে পুরুত হাইজ্যাক করতে হয়। তবে সেগুলো সাধারণত পাড়ার পুজোয় দেখা যায়। বাড়ির পুজোর ক্ষেত্রে বাঁধা ঠাকুরমশাই থাকে।

বেশ!

কিন্তু আমাদের রক্তিম...চক্কোত্তি হওয়া সত্ত্বেও ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের ‘র’ফলাটা নিয়েও কোনওদিন মাথা ঘামায়নি!

চক্কোত্তি তো মশাই পাওয়া – টাইটেল। খাঁটি আগমার্কা ব্রাক্ষ্মণ চান তো উপাধ্যায় ধরে এগোন। এই যেমন ধরুন মুখোপা...

...মাঝপথে বাগড়া দেবেন না।

আচ্ছা আচ্ছা, বলুন! ভালো কথা – এই রক্তিমটি কে?

আমারই বয়সি একটি ছেলে ধরুন। সদাহাস্যময়, সদাসন্তুষ্ট, নির্লোভ, অতিসাধারণ, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন ও সৎ একটি ছেলে। একটা প্রাইভেট ফার্মে সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটার হিসেবে কাজ করে। মোটামুটি একটা বেতন পায়। আগে মেসে থাকত। ইদানীং উত্তর কলকাতায় একটা ছিমছাম দু-কামরার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে।

থাকল।

এবং মাসদুয়েক আগে ছোঁড়া সুশ্রী, উচ্চশিক্ষিতা তথা উচ্চাকাঙ্ক্ষী পায়েলকে বিয়ে করেছে।

এই মাসদুয়েক আগে-টা কোন মাসদুয়েক আগে? মানে আজ থেকে মাসদুয়েক আগে, নাকি...

ভালো প্রশ্ন! ধরে নিন সরস্বতী পুজো থেকে মাসদুয়েক আগে।

ধরলাম।

এও ধরুন যে এরও বছরখানেক আগে দুজনের কোনও এক সফটওয়্যার ওয়ার্কশপে আলাপ হয়। রক্তিমের কোম্পানি টুক পার্ট ইন দ্য ইভেন্ট আর পায়েল তার কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে এমনিই কোনও একটা সন্ধে কাটাতে সেখানে গিয়েছিল।

আর সেখানেই দুয়ে দুয়ে চার?

অনেকটাই। পায়েলকে কম্পিউটারের কীসব খুঁটিনাটি রক্তিম খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

...এবং ভাইরাস’টা ধরে নিয়েছিল!

একেবারে! আর তার কিছু মাস পর বিয়ে হল রেজিস্ট্রি অফিসে।

শুধু রেজিস্ট্রি? মানে, মেয়ের বাড়ি থেকে আপত্তি ছিল?

মোক্ষম ধরেছেন। সঙ্গত কারণও ছিল। মেয়েরা আক্ষরিক অর্থে মধ্য কলকাতার বনেদী বংশ। সেই বাড়ির মেয়ে সামান্য একটা গ্র্যাজুয়েট পাশ চাকরিজীবীকে বিয়ে করবে, আর সেটা...মানে বুঝতে পারছেন তো? টিপিক্যাল যে ধরণের ঝামেলা পাকিয়ে থাকে...

আর ছেলের আগে পিছে?

রক্তিমের দেশের বাড়ি নদীয়ায়। বাবা রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার। শুনেটুনে নাকি বলেছিলেন, ‘আমাদের পরিবারে প্রেম করে’...এট্সেটরা এট্সেটরা...মানে সেই একইধরনের কিছু ক্লিশেড কথাবার্তা!

আচ্ছা, এই রক্তিমের পরিবারও কি...

...পূর্ববঙ্গের লোক ছিলেন তিন পুরুষ আগে। ধরে নিন সেই সমস্ত বাঙালদের একজন, যারা পার্টিশানের আগে মোটামুটি পূর্বগোলার্ধটাই তাদের ছিল বলে দাবি করেন।

কিছু মনে করবেন না, আমিও বাঙাল। আমি কিন্তু কখনও...

দয়া করে ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যাবেন না।

আচ্ছা আচ্ছা, বলুন।

তা রক্তিম যেমন নিজের বাড়িতে গিয়ে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, ঠিক তেমনি পায়েলের বাড়িতেও আনুষ্ঠানিক স্তরে কথাবার্তা বলতে গিয়েছিল। কিন্তু ভাবী শ্বশুরের কাছ থেকে মিহি করে অপমান ছাড়া বিশেষ কিছুই জোটেনি। সে মিটিং-এর দুদিন পর রক্তিমের ফ্ল্যাটে এসে পায়েল ছলছল চোখে বলেছিল, ‘তোমার খুব খারাপ লাগল না সেদিন?’ রক্তিম যথারীতি একটা নিষ্পাপ হাসি হেসে বলেছিল, ‘কী যে বল! আমি যার কাছ থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিষটা নিয়ে যেতে চাইছি, সে অত সহজে নিজের দাবি ছাড়ে কী করে বল!’

গুড সেইড!

পায়েল রক্তিমের এই আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যাটিটিউড, এই সিমপ্লিসিটি-টাকেই ভালবেসে ফেলেছিল। ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্না মেয়ে। ওসব বনেদী-টনেদীর ডিসকোর্স সযত্নে পাশে সরিয়ে রেখে সঠিক দিনটিতে স্যুটকেস’টা হাতে নিয়ে সোজা রেজিস্টারের অফিসে চলে এসেছিল।

...এবং হই হই করে সই করে দিয়েছিল!

খুব একটা হই হই করবার মত বিশেষ কেউ ছিল না। দু-একজন কমোন বন্ধুবান্ধব, পায়েলের এক দূর সম্পর্কের দিদি আর রক্তিমের ছোটবেলাকার ও খুব কাছের বন্ধু অয়ন। অয়ন সরকার। সরকারী অফিসের গেজেটেড অফিসার। তিরিশের কোঠাতেই বয়েস, কিন্তু তার দাপটে নাকি অফিসের বাঘ আর গরুতে একই ফিল্টার থেকে জল খায়। শিক্ষিত, ভদ্র, সভ্য, গম্ভীর এবং রক্তিম অন্ত প্রাণ। শোনা যায়, রক্তিমের পায়েলকেই পছন্দ জেনে অয়নও নাকি একবার মেয়ের বনেদী বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। কিন্তু ভদ্রলোক শুরুতেই রক্তিমের চাকরি-বাকরি বা অর্থকরি নিয়ে কিছু উলটোপালটা মন্তব্য করায়, অয়ন তার স্বভাবসিদ্ধ ব্যারিটোনে বলেছিল, ‘আমি কারোর তরফ থেকে কোনওরকম প্রস্তাব নিয়ে আসিনি। ভালোবাসা কোনও প্রস্তাবের অপেক্ষা রাখে না যা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে পারে। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক মানুষ একসঙ্গে ঘর বাঁধতে চায়, আমি সেই বিষয় আপনার সমর্থন চাইতে এসেছি। তার মানে কিন্তু এই নয় যে আপনি সমর্থন না করলে ব্যাপারটা মাঝপথে থেমে যাবে। ওদের সঙ্গে আর কেউ না থাকুক, অয়ন সরকার রয়েছে...’

ওহ্, বাঘের বাচ্চা!

অয়ন আর রক্তিম সমবয়েসী হলেও প্রথমজন পরেরজনকে অনেকটাই পুত্রবৎ স্নেহ করে। তাই যদি অয়ন কখনও খবর পায় যে রক্তিমের কিছু প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে অয়নের ভাষায় ‘এক দেবাদিদেব ছাড়া ত্রিলোকে আর তো কাউকে দেখছি না, যে ব্যাপারটা আটকাতে পারে...’!

ভাবা যায়!

সেই অয়ন যেমন নভেম্বর মাসের বিয়েতেও সাথ দিয়েছে, ঠিক তেমনই মাঘ মাসের শুক্লা পক্ষে পঞ্চমী তিথিতেও সকাল পৌনে নটায় রক্তিমের ফ্ল্যাটে বসে সরস্বতী পুজোর ফল কাটছে। পায়েল লালপেড়ে একটা শাড়ি পরে ভোরবেলাতেই স্নান-টান সেরে পুজোর যোগারে ব্যস্ত। আর রক্তিম একটা টাওয়েল পরে খালি গায়ে ‘হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে বলছে, ‘এই চানে যাই, এই চানে যাই!’

বাহ্!

একটু তাড়াহুড়োর পরিস্থিতি রয়েছে। কারণ, পঞ্জিকার পাঁয়তারা। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পঞ্চমী লাগছে, আবার অন্য কোনও পরিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে নাকি ছাড়ব ছাড়ব করছে। ফলত উদ্যোগহীন রক্তিমকে অয়নের কাছে মৃদু বকা খেয়েই স্নান করতে যেতে হয়েছে। এক্ষেত্রে রক্তিমের স্নান করাটা জরুরি। কারণ, পুরুত না পাওয়ায় শেষমেশ ঠিক হয়েছে যে রক্তিমই পুজো করবে। সে সকালবেলা পায়েলকে প্রলম্বিত একটা চুম্বন উপহার দিয়ে বলেছে, ‘আরে আমিও ব্রাক্ষ্মণ রে বাবা...!’ তাতে পায়েল ‘অগত্যা মধুসূদন’ এর মত ‘অগত্যা রক্তিম’কে মেনে নিয়েছে। যদিও একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাচ্ছে যে ব্যাপারটা নিয়ে মেয়েটা একটু চাপেই রয়েছে। এদিকে প্ল্যান শুনে অয়ন চটজলদি কোনও এক মহামহোপাধ্যায় বিরচিত ‘সহজে সরস্বতী পুজো শিখুন’ গোছের একটা চটি বই নিয়ে চলে এসেছে।

একেবারে কেলোর কীর্তি মশাই...

এখানে বলে রাখা জরুরি যে কেউ কিছু কিছু বিষয় একটু সেনসিটিভ হন। সরস্বতী পুজোটা পায়েলের কাছে অনেকটাই সেরকম। মেয়েটা ম্যাথামেটিক্সে পোস্ট গ্র্যাড শেষ করে এখন একটা কলেজে পার্ট-টাইম লেকচারার এবং অচিরেই জি-আর-ই দিয়ে ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটিতে পি-এইচ-ডি করবার স্বপ্নে বিভোর। ছোটবেলা থেকেই তার কাছে সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়া ও ভক্তিভরে অঞ্জলি দেওয়ার একটা আলাদা মাহাত্য রয়েছে। এক্ষেত্রেও এ বাড়িতে পুজোর উদ্যোগটা প্রধানত তারই। ঠাকুরও সে-ই পছন্দ করে কিনেছে। সো ফার রক্তিম ইজ কনসার্ন্ড, সে জীবনে কোনও পুজোপার্বণে প্রসাদ খাওয়া ছাড়া অন্য কোনও ভূমিকা পালন করেনি। তাই, একে নভিস বামুন, তায় বই দেখে পুজো। অতএব পায়েলের টেনশনটা সহজেই অনুমেয়, এবং সেটা আরও বেড়ে গেল যখন পুজোয় বসেই পুরুতমশাই বললেন, ‘বস, সামনে কারোর পরীক্ষা বা রেজাল্ট-ফেজাল্ট নেই তো? যে যার নিজের রিস্কে কিন্তু...!’

রসিক নাগর!

হ্যাঁ! তবে ও রসবাক্য শুনে বামুনের পেছনে বসা দুজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল এবং পায়েল অস্ফুটে বলেছিল, ‘আমার জি-আর-ই...!’

তারপর?

বলছি। এইবার পুজো শুরু হল। তবে তার আগে স্নান সেরে রক্তিম বেশ কয়েকবার বইটাতে চোখ বুলিয়ে মুখস্থ করবার মত বিড়বিড় করছিল। সেটা দেখে অয়ন একসময় শাঁকালুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলেছে, ‘মুখস্থ করছিস কেন? আরে দেখে দেখে করবি, তাহলেই তো হল!’ অতএব সবই মোটামুটি ইন প্লেস। পায়েল রক্তিমকে লুঙ্গির মত করে একটা ধুতিও পরিয়ে দিয়েছে। ঠাকুরমশাই পুজোয় বসে গিয়েছেন। বাঁহাতে বই।

ফাইন!

ঠাকুরমশাইয়ের পরবর্তী বাক্য, ‘আচ্ছা, আয়োজন সব ফর্দমালা মিলিয়ে হয়েছে তো? মাইরি এখানে পঞ্চগুঁড়ি বলে কী একটা বেশ বলছে...!’ পেছনে বাবু হয়ে বসা অয়ন বলল, ‘পাঁচ রকমের গুঁড়ো। আগেকার দিনে বেলপাতা, জবাফুল ইত্যাদি গুঁড়ো করে দেওয়া হত। এখন আবির দেওয়া হয়। সামনে থালায় রাখা আছে।’ শুনে রক্তিম হাসিমুখে বলতে গেছিল, ‘তুই দেখছি অনেক কিছু...!’ তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অয়ন ঘড়ি দেখে বলল, ‘লগ্ন বয়ে যাচ্ছে। শুরু কর!’... তা পুজো শুরু হল। আবার হোঁচট, ‘এখানে তো শালগ্রাম শিলার কথা বলছে রে!’ অয়নও আবারও জবাব দিল, ‘স্কিপ করে যা। এখন নারায়ণ খুঁজতে পারব না।’ শুনে পায়েল অস্ফুটে আরও একবার বলল, ‘জি-আর-ই!’

ওহ্, ছড়িয়ে না যায়।

তারপর ঠাকুরমশাই বললেন, ‘আচমন। অ্যা:, এটা আমি জানি,’ বলেই ডানহাতে কোশাকুশী থেকে তিনবার জল নিয়ে সেটা খেয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ওঁ বিষ্ণু:, ওঁ বিষ্ণু:, ওঁ বিষ্ণু:,’ আর তারপরই পায়েলের দিকে ঘুরে বললেন, ‘কী, কেমন বললুম?’ পায়েল শুকনো একটা হাসি হাসল। ঠাকুরমশাই ফের সামনের দিকে ঘুরে পুজোয় মন দিলেন। ধরে ধরে বিষ্ণুস্মরণ হল, ‘ওঁ তদ্বিষ্ণো: পরমং পদম্...!’ পুজো চলছে। এরপর স্বস্তিবাচন। পুরুত চেঁচাচ্ছেন, ‘আতপ চাল, আতপ চাল...!’ পায়েল বলছে, ‘সামনে সামনে!’ সেটা পাওয়া গেল। সেই আতপ চাল বামহস্তে রাখিয়া দক্ষিণ হস্তদ্বারা আচ্ছাদন পূর্বক ব্রাক্ষ্মণ মন্ত্র পড়িতে পড়িতে বলিলেন, ‘কী বড় বড় শব্দ রে!’ পশ্চাৎ হইতে আওয়াজ আসিল, ‘ভেঙে ভেঙে পড়। ছড়াস না...!’

এ:, এ যে একেবারে...

তারপর শুনুন। এরপর সামবেদীয় স্বস্তিসূক্ত, তারপর যজুর্বেদীয় এবং শেষে ঋগ্বেদীয় মন্ত্র। ব্রাক্ষ্মণ পড়তে পড়তে বললেন, ‘ওঁ স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবা: স্বস্তি ন পূষা...এই এইটাও আমি জানি মাইরি। সর্বত্র টিভি সিরিয়ালে পুজো দেখালেই মন্ত্র হিসেবে এইটা আওড়ায় ভাই। বল, ঠিক কিনা বল...!’ যাই হোক, পুজো চলছে। ঠাকুরমশাই বিড়বিড় করতে করতে পাতার শেষ জায়গায় পৌঁছিয়ে বললেন, ‘এইবার বরণ। গৃহকর্তা পুরুতকে বলবেন...গৃহকর্তা? সেরেছে! এখানে তো গৃহকর্তাই পুরুত!’ অয়ন নিমেষে উপায় বাতলে দিল, ‘পায়েল বল অ্যাজ গৃহকত্রী।’ পায়েল বই দেখে বলল, ‘যথাবিহিত পূজক কর্ম কুরু।’ শুনে আমাদের ঠাকুরমশাই বললেন, ‘একদম চাপ নিও না। যথাজ্ঞানং করবাণি!’

বেড়ে হচ্ছে! দেবী তড়াক করে লাফ মেরে যে দৌড় লাগাননি, এই ঢের!

না, তেমন কিছু হয়নি। পুজো এগোচ্ছে। এবার অধিবাস। পুরুত মন্ত্র দেখে বিড়বিড় করছেন, ‘অধিবাস না অধিবাঁশ কে জানে...!’ তারপর মন্ত্র, ‘এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ গণেশায় নম:, ওঁ কাল্যাদি দশমহাবিদ্যাভ্যো নম:...!’ চলছে। শেষ হল। এরপর সামান্যার্ঘ্য স্থাপন। ভূমিতে ত্রিকোণমণ্ডল করে মণ্ডলে, ‘ওঁ আধারশক্তয়ে নম:, ওঁ কূর্মায় নম:, ওঁ অনন্তায় নম:...!’ হল। তারপর দ্বারপূজা। আবার পুরুত আটকালেন, ‘মাইরি এখানে বলছে জল দিয়ে ফট্ মন্ত্রে দ্বারদেশ অভ্যুক্ষণ করে – এই ফট্-টা আবার কী ধরণের মন্ত্র রে? যেমন দ্যাখ, বিঘ্ন অপসারণ করতে গিয়ে বলছে, ওঁ অস্ত্রায় ফট্!’ অয়ন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘টপকে যা!’ পায়েল টেনশনের চোটে তিনবার শাঁখ বাজিয়ে দিল।

ওহ্, একটা...!

এরপর আসনশুদ্ধি, ‘ওঁ হ্রীং আধারশক্তয়ে কমলাসনায় নম:!’ তারপর পুষ্পশুদ্ধি, তারপর প্রাণায়াম। ঠাকুরমশাই কষে নিঃশ্বাস নিয়ে চলেছেন আর বলে চলেছেন, এটা রামদেব দেখায়!’ তারপর ভূতশুদ্ধি, করশুদ্ধি। বামুন বলছেন, ‘গুষ্টির মাথা। সারাক্ষণ ধরে খালি শুদ্ধিই করে চলেছি...!’ পায়েল ভাবছে, হয়ে গেল। আর জি-আর-ই! আর ঠাকুরমশাই হঠাৎই বলছেন, ‘মনে পড়েছে। আমি পৈতে পরিনি...!’ অয়ন হাল ছেড়ে বলল, ‘ধুত্তোর!’ পায়েল বলছে, ‘এবার?’ ঠাকুরমশাই আবারও চেঁচাচ্ছেন, ‘আছে আছে। আলমারির ভেতর, লকারের ওপর। পায়েল!’ পায়েল দৌড়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে নিমেষে লিকলিকে কয়েকটা সুতো নিয়ে এল। সেটা পরে আবারও রক্তিমের মুখে হাসি, ‘এইবার দেখবি, ব্রক্ষ্মতেজ কাকে বলে। যদিও চেনা বামুনের লাগে না, তবু...’

ওহ্, একটা ঘোটালা পাকছে মশাই!

তারপর শুনুন। এবার দেবীকে চক্ষুদান এবং তারপর প্রাণপ্রতিষ্ঠা। একটা বেলপাতায় কাজল তুলে কুশের ডগা দিয়ে সেটা প্রথমে দেবীর বাম মণিতে ও তারপর ডান চোখে আস্তে করে লাগিয়ে দিতে হবে। ঠাকুরমশাই দুপায়ের হাঁটুতে ভর দিয়ে সামনে ব্যালেন্স করে ঝুঁকে কাঁপা কাঁপা হাতে দেবীকে কাজল পরাচ্ছেন। ঠিক সেই সময়টিতে পরবর্তী বিপত্তি।

কী হল?

পায়েল চেঁচাচ্ছে, ‘দেখে দেখে! সামনে প্রদীপ, আগুন!’ আর রক্তিম চেঁচাচ্ছে, ‘ধুতি ধুতি!’

অ্যাঁ!

অর্থাৎ হাঁটুর টান লেগে পুরুতের লুঙ্গির মত করে পরা ধুতি খুলে গেছে। রক্তিম ওই অবস্থাতেই দেবীর চোখে কুশের ডগা ঠেকিয়ে চেঁচাচ্ছে, ‘গেল গেল গেল গেল। ধর ধর ধর ধর!’ অবস্থা বুঝতে পেরে অয়ন পেছন থেকে খপাৎ করে রক্তিমের কোমর জড়িয়ে ধরেছে। পায়েল তখনও বলে চলেছে, ‘আগুন দেখে, আগুন দেখে!’ অয়ন বামুনের কোমরে ধুতিতে গিঁট মারছে, আর বামুন ওই অবস্থায় মন্ত্র পরে চলেছে, ‘ওঁ আপ্যায়স্য সমেতু তে বিশ্বতঃ সোম...!’ পায়েল পেছনে দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজাচ্ছে।

স্প্লেনডিড! স্প্লেনডিড!

তারপর আবার পুজো এগোচ্ছে। গণেশের পুজো, সূর্যের পুজো, বিষ্ণুর পুজো, শিবের পুজো, দুর্গার পুজো করে প্রধান পুজো, ‘ওঁ ঐং সরস্বতৈ নমঃ!’ হয়ে টয়ে যাওয়ার পর এইবার অঞ্জলি। ঠাকুরমশাই শুরু করলেন, ‘ওঁ জয় জয় দেবী চরাচরসারে...আরে এটা তো পড়ে না। এটা তো অঞ্জলি দেওয়ার পর ঠাকুরমশাইরা নিজে নিজে বলেন। এই তো। পেয়েছি পেয়েছি! হ্যাঁ, এই তো – সাধারণের পুষ্পাঞ্জলি। নে, হাতে ফুল নে। নিয়েছিস সব? এবার বল আমার সঙ্গে – নমঃ অপবিত্রো পবিত্র বা সর্বাবস্থাং গতোহপি বা...!’

এই তো হচ্ছে।

তা হচ্ছে। পায়েল দুচোখ বুজে এক মনে মন্ত্র উচারণ করে চলেছে। মেয়েটার ভক্তিতে কিন্তু কোনও খাদ নেই। যতটা সম্ভব পজিটিভিটি ড্র করা যায়, ভক্তির মাধ্যমে মেয়েটা সকাল থেকে সেটাই করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কষে উচ্চারণ করছে, ‘বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোহস্তু তে!’

বাহ্, গুড গার্ল!

সেই। এরপর ঠাকুরমশাই সব হয়ে টয়ে গেলে উঠে দাঁড়ালেন। বাঁহাতে খোলা বই ও ঘন্টা। ডানহাতে অন্যকিছু। ঘন্টা নাড়াতে নাড়াতে মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে। সেও এক অদ্ভুত হচ্ছে। ঘন্টা নাড়ালে বইও নড়ছে। খুদে খুদে অক্ষর। ব্রাক্ষ্মণ দেখতে পারছেন না। শেষে অয়নের দিকে ফিরে বলল, ‘ভাই, এ তো চাপ হয়ে যাচ্ছে!’ অয়ন বলছে, ‘কী হল?’ রক্তিম, ‘না, মানে বলছি ঘন্টা নাড়াতে গিয়ে বইও নড়ে যাচ্ছে। পড়তে পারছি না যে!’ শেষে অয়ন একপাশে বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠাকুরমশাই তাই দেখে দেখে আর ঘন্টা নাড়াতে নাড়াতে নিজের মনে পড়ে চলেছেন। পেছনে পায়েল কাসর বাজাচ্ছে...

একটা এক্সপেরিয়েন্স বটে!

“পরবর্তী স্টেশন শ্যামবাজার। প্ল্যাটফর্ম ডানদিকে!”

যাহ্, ছেড়ে দিল। তাড়াতাড়ি শেষ করুন মশাই। আপনি নামবেন কোথায়?

বেলগাছিয়া। আপনি?

আমি দমদম। বেলগাছিয়া তো শ্যামবাজারের পরই। তাড়াতাড়ি করুন, তাড়াতাড়ি করুন। তারপর কী হল?

সেদিন সে পুজোটা এভাবেই শেষ হয়েছিল। পায়েল খিচুরি রেঁধেছিল। দুপুরবেলা খাওয়া হয়েছিল। আর সন্ধেবেলা বেড়াতে বেরিয়ে তিনজন সিনেমাও দেখেছিল। অবশেষে সেদিন রাত্রে পায়েলকে কাছে টেনে রক্তিম বলেছিল, ‘পুজোটা তোমার মন মত হল না। তাই না? কিন্তু জান, আমি শুধু তোমার জন্যই পুজো করলাম। আমার কিচ্ছু চাওয়ার নেই। দেখো, তোমার জি-আর-ই কোনওভাবে আটকাবে না।’ পায়েল কথাটা শুনে রক্তিমের মুখটা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল। আর বোধহয় সেই মুহূর্তে কোনও এক রক্তিমাভা পায়েলের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

আহেম্, বলছিলাম কী...একটু বেঁধে!

হ্যাঁ হ্যাঁ! রেখেঢেকেই বলছি। বিশেষ ডিটেলস্-এ যাব না।

কিন্তু একটা ব্যাপার বলুন। আপনার চিন্তাটা কী নিয়ে? অ্যাদ্দুর অবধি তো চিন্তাজনক কিছু পেলাম না।

বলছি। পায়েলের জি-আর-ই করতে যাওয়া মানে রক্তিমকে ছেড়ে বিদেশে পড়ে থাকা। সেক্ষেত্রে বিরহের বা ছাড়াছাড়ির একটা প্রসঙ্গ চলে আসে। এখন মুশকিল হচ্ছে, রক্তিমের সঙ্গে এই কটা দিন থেকে পায়েলের এখন অদ্ভুত একটা রক্তিমাভ্যাস হয়ে গেছে।

ভালো বাংলা!

হ্যাঁ, তো সেই অভ্যাসটা দিনের পর দিন জাঁকিয়ে বসছে। অবশ্য তার মানে কিন্তু এটা ভাববেন না যে পায়েল কোনওভাবে তার স্বপ্ন ছেড়ে সরে এসেছে। কিন্তু এই যে তার স্বপ্নপুরণের পথে বিরহের একটা ভূমিকা, সে এটা নিয়ে চিন্তিত।

বুঝলাম। তা আপনার চিন্তাটা কীসের?

আজ্ঞে?

বলছি, আপনিও কী এটা নিয়েই চিন্তায় আচ্ছন্ন?

না, আরেকটা ঘটনা ঘটেছে।

তাড়াতাড়ি বলুন, তাড়াতাড়ি বলুন।

“পরবর্তী স্টেশন বেলগাছিয়া, প্ল্যাটফর্ম ডানদিকে! আগলা স্টেশন বেলগাছিয়া, প্ল্যাটফর্ম ডাহিনে তরফ! নেক্সট স্টেশন ইজ বেলগাছিয়া, প্ল্যাটফর্ম ইজ অন রাইট সাইড!”

শেষ করুন মশাই, শেষ করুন।

এই বলি। সরস্বতী পুজোটা কাটার পর থেকে রক্তিমেরও কেমন জানি মনে হতে শুরু হয়েছে, যে পুজোর নাম করে যেটা হল, তাতে পায়েল যারপরনাই আহত। ফলত, সে পায়েলের কেরিয়ার নিয়ে একটু বেশী মাত্রাতেই চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

যত্তোসব! গেঁড়েব্যাটা তখন পুজোর নামে ফচকেমি করার সময় একথা মনে আসেনি!

আগেই বলেছি, কেউ কেউ কিছু কিছু বিষয় নিয়ে একটু স্পর্শকাতর হয়েই থাকে। আমাদের পায়েলও সরস্বতী পুজো নিয়ে অনেকটাই তাই। এখানে আরেকবার বলে রাখি, এগুলোকে কিন্তু কুসংস্কার বলে ধরবেন না।

ধরছিও না। আমার তো বেশ শিশুসুলভ সারল্যই মনে হচ্ছে।

কিন্তু রক্তিমের এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না। সে ভাবছে, দেবী রুষ্ট হলেন না তো? যদি তাই হয় – তাহলে তার না হয় বিদ্যের দৌড় থেমেই রয়েছে, কিন্তু পায়েলেরটাও যদি...। কখনও একলা ঘরে পায়চারি করতে করতে রক্তিম এটাও ভেবেছে যে, ‘আহ্, যদি একজন পুরোহিত ধরে আনতে পারতাম।’

গেরো!

ওদিকে পায়েল যথারীতি পুজো-টুজো ভুলবার চেষ্টা করে তার কলেজের চাকরি এবং জি-আর-ই’র প্রিপারেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার যাতে পড়াশুনায় কোনও ব্যাঘাত না ঘটে, সেটা ভেবে রক্তিমও দায়িত্বশীল বরের মত সংসারের নানান কাজ নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। অর্থাৎ রান্না করা থেকে শুরু করে সপ্তাহান্তে একবার জানলার গ্রিল পরিষ্কার করা – সবই দুহাতে করে যাচ্ছে। আর পায়েল বইয়ের ফাঁক থেকে লুকিয়ে রক্তিমকে দেখছে, আর...

...আর? আর কী মশাই?

আর আরও প্রেমে পড়ে যাচ্ছে!

বাহ্, দিব্যি এগোচ্ছে। তারপর কী হল?

এখন এই ভালোলাগাটা আস্তে আস্তে এমন স্তরে গেছে যে মাঝখানে নাকি পায়েলের বাবা, মানে সেই বনেদী সেয়ানা, যখন তাকে ফোন করে তখন সে বিরক্তিভরে বলেছে, ‘বিরক্ত কোর না। আগে মানুষ চিনতে শেখ, তারপর আবার তোমার আমার কথা হবে!’ অর্থাৎ, এই আস্তে আস্তে রক্তিমকে চিনতে পারাটা পায়েল বেশ এনজয় করছে।

বুঝেছি। শেষমেশ আমে-দুধে এক হয়ে যাবে। আর মাঝখান থেকে জি-আর-ই গড়াগড়ি খাবে, এই তো?

যাই হোক, পায়েল রীতিমত তার প্রিপারেশন নিয়ে কনফিডেন্ট হয়ে নির্দিষ্ট সময় পরীক্ষা দিতে চলে গেল। চলে গেল বললে ভুল হবে, বলা ভালো, সেদিন অফিসে ছুটি নিয়ে রক্তিম নিজে পায়েলকে আমেরিকান সেন্টারে পৌঁছে দিল। শুধু তাই নয়, ছোকরা সারাক্ষণ সেন্টারের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। একসময় পায়েল যখন বেরিয়ে এল, তাকে দেখে রক্তিম প্রথমেই চোখ বড়বড় করে যে কথাটা জিজ্ঞাসা করল, সেটা হচ্ছে, ‘কেমন হল?’

সেই...কেমন হল?

পায়েল হেসে বলল, ‘ভালো!’

বাহ্, তাহলে শেষমেশ কী হল?

এই, এইখানটাতেই গণ্ডগোলটা বেঁধেছে।

যথা...

যথা আজ পায়েলের সেই জি-আর-ই’র রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে নেটেই চেক করে নিতে পারত। কিন্তু দুপুরবেলায় কলেজ থেকে বেরিয়ে সটান একলা একলাই আমেরিকান সেন্টারে গিয়ে রেজাল্ট জেনে এসেছে।

একটা কথা বলুন, এই জি-আর-ই কি খুব শক্ত কোনও পরীক্ষা?

খুব একটা সোজা বলেও তো জানি না। বাইরে পড়তে গেলে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে জি-আর-ই’র নির্দিষ্ট একটা গ্রেড থাকে। সেটা কোয়ালিফাই করতে পারলেই একমাত্র সেই ইন্সটিটিউটে পরা যায়। এক্ষেত্রে পায়েলের গ্রেড’টা ম্যাসাচুসেটস্ ইউনিভার্সিটির নির্ধারণ করা গ্রেড’কে ছাপিয়ে যেতে হবে, একমাত্র তবেই সে কোয়ালিফাইড।

যাহ্, ট্রেন বেলগাছিয়া ঢুকছে। আপনি তো এবার নেমে যাবেন।

হ্যাঁ, আমার স্টেশন এসে গেছে।

কিন্তু শেষটা কী হল? চিন্তাটাই বা কী নিয়ে করছিলেন, জানতে পারলুম না যে...

শেষ কিনা জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি যে পায়েল সেই আমেরিকান সেন্টারের বাইরে থেকে রক্তিমকে ফোন করেছিল। রক্তিম প্রথমেই জানতে চাইল, ‘রেজাল্ট কী হল?’ জানেন, ফোনটা কানে ধরে মেয়েটা বিকেলের আলোয় এই শহরের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকল...!

মানে? হাঁটতে থাকল? তা হাঁটুক...কিন্তু...ও মশাই, নেমে যাচ্ছেন যে! আরে মেয়েটার রেজাল্ট’টা কেমন হল?

কেমন হওয়া উচিৎ বলুন তো? ভালো হলে স্বপ্ন আগে এগিয়ে আসে, খারাপ হলে স্বপ্নের মানুষটা। ওই সরস্বতী পুজোটা কি ঠিকঠাক হয়েছিল?...আচ্ছা, আসি তাহলে!

মানে? এ কী, নেমে গেলেন যে! কিন্তু কিন্তু...

“পরবর্তী ও প্রান্তিক স্টেশন দমদম। প্ল্যাটফর্ম...!”

আপনার মন্তব্য