একটি ‘পাঠক প্রতিক্রিয়া’ পাঠ শেষে : মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-০৫ ২২:০১:৩৫

শামস শামীম:

বাংলাসাহিত্যের গবেষক ড. সফিউদ্দিন আহমদ এই অভাজনকে কয়েক বছর আগে বলেছিলেন যে, কিছু মানুষ এখন সংস্কৃতিবান হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সমাজে ধন-জন থাকার পরও তাদের খায়েশ হয় একটু সংস্কৃতিবান সাজতে, আর সাজতে পারলে জীবনের ষোল আনাই বুঝি পূর্ণ হলো। প্রয়োজনে কাড়ি কাড়ি কড়ি ঢেলে তারা সংস্কৃতিবান হওয়ার হাস্যকর চেষ্টা করে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সময়কার সংস্কৃতিবানদের লম্পজম্প দেখে বলেছিলেন, ‘যাহার যোগ্যতা যত অল্প, তাহার আড়ম্বর তত বেশি’। তথাকথিত সংস্কৃতিবানদের সেই অসার আড়ম্বর আমরা এখন হর হামেশাই দেখি, বিভিন্ন দিবস-উৎসব-পার্বণ এবং গণমাধ্যমে। চারপাশে সংস্কৃতিচর্চার নামে যত্রতত্র অগভীর ও আপাতত রসালো, সর্বার্থে তাৎপর্যহীন আড়ম্বরতাকেই আমরা দেখছি, আর তাতেই অভ্যস্ত হয়ে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। আমরা নালায়েক আমজনতা বুঝে নিয়েছি যারা গান গায়, নাটক করে, ঢোল-করতাল বাজায়, মঞ্চে হর হামেশা মুখ দেখায় তারাই ‘প্রকৃত’ সংস্কৃতিবান! সর্বত্র নিরন্তর এক বিজ্ঞাপনের মিছিল চলছে, যেন চলবেই। শঙ্খঘোষের ‘ভাবি আমার মুখ দেখাব, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’র মতো। এর বাইরে অন্যরা ধুত্তরি, ছাই!

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ম্যাকলের শিক্ষানীতির অনুসরণে ভারতবর্ষে সুবিধাভোগী যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি করেছিল সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই কিছু প্রতিনিধি আজ সংস্কৃতির ধারক-বাহক! আমাদের প্রগতিশীল তাত্ত্বিকরা যাদেরকে চামড়ায় ভারতবর্ষী ও মনমগজে ইংরেজ বলেছেন। এরা প্রকারান্তরে তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরি। আমাদের অঞ্চলে এই তথাকথিত সংস্কৃতিবানদের মধ্যে যাকে বলে সৃজনশীলতার স্ফুরণ আমরা নিম্নবর্গীয় লোকজন দেখতে পাচ্ছি না। পাঠক, নিউজের মানুষ হয়ে ভিউজে কাণ্ডজ্ঞান ফলানোর লাগি মাফ চাই।

সম্প্রতি মতিউর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের বানানবিভ্রাটে ভরপুর একটি লেখা প্রকাশ করে আমরা বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে সমালোচিত হচ্ছি। সাধারণ পাঠকের পাতে একটি পরিশুদ্ধ লেখা পরিবেশন করার স্বার্থে পত্রিকা সংশ্লিষ্টরা স্বপ্রণোদিত হয়ে যে কোন লেখারই বানান শুদ্ধ করে প্রকাশ করেন, এটাই সাধারণ নিয়ম। সা রে গা মা সম্পাদক ও অধ্যক্ষ অণীশ তালুকদার বাপ্পু মহোদয়ের গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত লেখাটি তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়ে কোনরূপ কাটাকাটি করার সাহস আমরা করিনি, তাঁর অসাধারণ লেখাটিকে উপর্যুক্ত সাধারণ নিয়মের মধ্যে ফেলে দিয়ে প্রকারান্তরে তাঁকে অবহেলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ পাণ্ডিত্যের উপর অনর্থক পাণ্ডিত্য ফলানোর অবিমৃষ্যকারিতা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা সুবুদ্ধির পরিচায়ক বলে মনে করেছি। এমনটি করার আর একটি কারণ হলো এটা সর্বজনের জানা কথা যে, নিজের ছিদ্র উন্মুক্ত রেখে কেউ অপরের ছিদ্রান্বেষণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে না, যদি করে তবে সাধারণ মানুষের কাছে তার কাণ্ডজ্ঞান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এবং আমজনতার যে কেউ ওই উন্মুক্ত ছিদ্রে আঙ্গুলিং করার মওকা পেয়ে যায়। তারপরও গুণীজনকে সম্মান দেখাতে গিয়ে এখন সর্বকর্মের গুণবিচারক পাঠকের কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে আমাদের। এরকম একটি লেখা পত্রস্থ করার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমাদের প্রিয় পাঠকরা বিব্রত হয়েছেন। সেজন্য আমরা দুঃখিত।

দুই.
ম্যাৎজেরাতের জনক নোবেলজয়ী গ্যুন্টার গ্রাস বলেছেন ‘মানুষ আপোস করে বাঁচে, কবিতা কিন্তু আপোস চেনে না’। তিনি আরো বলেছেন, ‘শিল্প সদা আপোসহীন এবং জীবন স্বভাবত সম্পূর্ণ আপোসের’। নিজেকে নীতি-নৈতিকতার ধারক-বাহকও উত্তম দৃষ্টান্ত করে তোলতে মেরুদণ্ড সোজা রাখা, তোষামোদি না করা, ভাঁড়ামি না করা জীবনে চলার পথে প্রভৃতি কষ্টকর কর্মসম্পাদন যে কোনও মানুষের জন্যে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেও সে আদর্শের প্রতিফলন চাই। এই প্রতিফলনই হলো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় এমন চিত্তপ্রকর্ষের বিপরীত চর্চা কালে কালে বাড়ছে। হালে এইসব কুচর্চার বাড়বাড়ন্ত বড় বেশি চোখে বাজে। যে যত বেশি ভাঁড়ামি, তোষামোদির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে, আর এইভাবে অপসংস্কৃতির চর্চা করে, স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার ও আত্মপ্রচার-প্রসারে উদ্বাহু নৃত্য করে, সে পায় সংস্কৃতিবানের সার্টিফিকেট তত সহজে। তবে এর বিপরীত চর্চাও একেবারে দুর্লক্ষ্য নয়। নীরবে-নিভৃতে সংস্কৃতির রস আস্বাদন করে নিজেদের প্রস্তুত করছেন কেউ কেউ, তবে তাঁরা সংখ্যালঘু। তাঁরা প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করে তৈরি করছেন শিল্প-সাহিত্যের ফসলি বীজতলা। অনেকটা মহাভারতের বীর গদাধর ভীমপুত্র ঘটোৎকচের মতো। কুন্তীর কূটচালে সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়ে পাণ্ডব বংশের ‘জঙলি’ এই পোলা চতুর কৃষ্ণ এবং বীর কর্ণের সমকক্ষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন, অস্ত্রে এবং শাস্ত্রে। যাঁকে কৃষ্ণের মতো বিশ্বসেরা কূটনীতিকও তর্কযুদ্ধে কাবু করতে ব্যর্থ হতেন। ভড়ঙ-ভাঁড়ামি ছাড়াই তিনি নিজেকে যোগ্য করে তুলেছিলেন।

তিন.
দৈনিক সুনামকণ্ঠে কবি ও গবেষক ইকবাল কাগজীর একটি লেখা ছাপা হয়েছিল গত ৫ ফেব্রুয়ারি। এই লেখার প্রতিক্রিয়া প্রকাশে সুন্দর একটি সমালোচনামূলক লেখা প্রস্তুত করা যেত অনায়াসেই। কিন্তু শেষতক যা হয়েছে তাকে পাঠ প্রতিক্রিয়া বলা যায় না। বলতে গেলে ‘ক্ষুব্ধ’ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সা রে গা মা সম্পাদক ও মতিউর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ অণীশ তালুকদার বাপ্পু। প্রতিক্রিয়ার শুরু এবং শেষ ‘ব্যক্তি আক্রমণ’-এ টইটুম্বুর। তিনি সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটির একজন সদস্যও। তাঁর মতো অনেক মান্যবরের উপস্থিতি সত্ত্বেও লোককবি ও সঙ্গীতসাধক রাধারমণ-এর নাম ভুল লেখা হয়েছিল। আমি যতটুকু জানি শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতেই লোককবি রাধারমণ দত্ত-এর নামে ভবনটির নামকরণ করা হয়েছিল এবং লেখা হয়েছিল ‘রাধারমন দত্ত ভবন’। যেখানে রাধারমণ-এর ‘ণ’ কে ‘ন’ লেখা হয়েছে। ইকবাল কাগজীর লেখার আগে তাদের চোখে এই ভুল ধরা পড়েনি। অথচ জমকালো উদ্বোধনের জন্য প্রায় মাস খানেক এই নতুন ভবনে ছিল শিক্ষিত-সুশিক্ষিত-স্বশিক্ষিত অনেকেরই নিত্য যাতায়াত।

সুনামগঞ্জে যাঁরা সংস্কৃতি, সাহিত্যচর্চা করেন, তাঁদের কাছে প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে ইকবাল কাগজীর পাণ্ডিত্য স্বীকৃত। ইকবাল কাগজী ব-রৈখিক এক বিরলপ্রজ কবি। ভাষার বহুরৈখিক বিশ্লেষণে সংখ্যালঘুদের একজন এই লেখক শব্দ ও বাক্য গঠনের খেলায় সিদ্ধহস্ত। দুই যুগ আগেই কাগজীর ‘নষ্ট কুসুমের কষ্ট’ প্রকাশের পর বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ কর্তৃক কাব্যগ্রন্থটি প্রশংসিত হয়েছে। দুই দশক আগে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী খান সুনামগঞ্জের লোককবিদের গানের সংকলন ‘অন্তরে তুষের অনল’ প্রকাশ করেছিলেন, সে সংকলনের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক মুখবন্ধ রচনা করেছিলেন ইকবাল কাগজী। ইচ্ছে হলে আপনারা পড়ে দেখতে পারেন। যেখানে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। মোহাম্মদ আলী খানের প্রযত্নে-অনুপ্রেরণায় এই কাজটি করেছিলেন তিনি এবং এটিই ছিল তাঁর এরকম গবেষণামূলক প্রথম কাজ। আর বিষয়টি ছিল তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নূতন ও তখনও অনধিগত। শুধু এই সংকলনই নয় সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত অনেক দৈনিক-সাপ্তাহিকসহ সাহিত্য সংকলনেও তাকে খুঁজে বের করে যুক্ত করেন সংশ্লিষ্টরা। তিনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বলে প্রাজ্ঞজনও তাঁর শরণাপন্ন হন। তিনিও বিনয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারতপক্ষে কার্পণ্য করেন না।

একটি মাত্র ভুল শব্দ থেকেই যে লেখক একটি সুখপাঠ্য, তথ্যবহুল এবং সংস্কৃতির ভেতরের ছবি প্রকাশ করে দিতে পারেন তিনি অবশ্যই মহৎ ও মেধাবী লেখক। এমন লেখার যোগ্যতা প্রকৃত লেখক ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে আমরা একটি দুর্দান্ত লেখা পেয়েছি। এই ধাঁচের গভীর লেখা স্থানীয়ভাবে আমরা কদাচিৎ দেখতে পাই।

সা রে গা মা সম্পাদক ও অধ্যক্ষ অণীশ তালুকদার বাপ্পু প্রতিক্রিয়ার শিরোনাম দিয়েছেন “একজন ইকবাল কাগজী’র ‘রাধারমণপ্রীতি’ এবং ‘ভুল’ শব্দ শুদ্ধিকরণে ‘ঢোল পেটানো’ প্রক্রিয়া”। তিনি লিখেছেন, “তবে বলবো এটা আপনার মনের ‘রাধারমণপ্রীতি নয়’ বরং আপনার দীর্ঘদিনের নির্বাসিত জীবন থেকে হঠাত (ব্যুৎপত্তি অনুসারে বানানটি ‘হঠাৎ’) প্রকাশিত হবার সুকৌশল।” তিনি কতটা ক্ষুব্ধ তাঁর লেখার শিরোনামেই তা বলে দিয়েছেন। তিনি শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে সাম্প্রতিক অর্থাৎ অদূর অতীতে সংঘটিত কূট-কচালকেও নিয়ে এসেছেন। তিনি লিখেছেন “আজ আপনি রাধারমণ বানাণ (‘বানান’-এর বানান ‘বানাণ’ কী করে হয়?) ভুল শুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস রচনা করেছেন কিন্তু ‘রাধারমণ কমপ্লেক্স’ তৈরী (‘তৈরী’-এর হালের ও প্রচলিত বানান ‘তৈরি’।) করার জন্য তো কোন পত্রিকায় আপনার কোন তীর্যক লেখা প্রকাশ করেন নি। যখন একটি মহল রাধারমণসহ অন্যান্য লোককবিদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘হাসন রাজা’ নামে নবনির্মিত শিল্পকলা ভবনের নামকরণ করা (শব্দান্তের ‘র’ কই পালাল?) পায়তারা (বাংলা ভাষায় ‘পায়তারা’ বলে কোন শব্দ নেই। এই ‘পায়তারা’ শব্দের অর্থ কী?) করছিল তখন তো আপনার কলমের এক বিন্দু কালি বের হয়নি। আসলে ঘি’র মধ্যে কাঁটা বাঁচতে (কী অবাক! ‘কাঁটা বাঁচতে’ আবার কী?) আমাদের সবারই ভাল লাগে।” ঠিক কথা। একদম সত্যি। ‘ঘি’র মধ্যে কাঁটা’ বাছতে (‘বাঁচতে’ নয়) আমাদের ভালই লাগে। আসল কথা ঘি’র মধ্যে যে কাঁটা আছে, সে সত্যের স্বীকৃতিটুকু তিনি দিয়েছেন বলে তাঁকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

কেউ যদি বাংলা বানানের প্রতি এমন উদাসীন হন তাহলে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরাও প্রভাবিত হয়ে ভুল শিখবে। যা কিছুতেই সঙ্গত নয়। এমন হতে দেওয়া বাংলাভাষার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করা, প্রকারান্তরে পাকিস্তানি আমলে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী দুর্বৃত্তের আধুনিক উত্তরসূরি হয়ে ওঠা ভিন্ন অন্যকিছু নয়।

বাংলা ভাষা ভুলে ভুলে ভরে গিয়ে একটি ভুল ভাষায় পরিণত হোক এটা কোন বাংলাভাষীর কাম্য হতে পারে না। অন্তত প্রমিতবাংলা চর্চার সময় চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করার কোন বিকল্প নেই। আমরা জানি না রাধারমণ দত্ত নিয়ে ইকবাল কাগজীর পাঠের পরিধি কতুটুকু। তবে আমাদের ধারণা রাধারমণের ব্যাপারে কবি ইকবাল কাগজী একেবারে মূর্খ নন।

তিনি আরো লিখেছেন “জোর করে কোন কিছু প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। আর লেখায় কঠিন ভাষা ব্যবহার করলেই হিরো হওয়া যায় না। এ শহরে যারা সাহিত্যকর্মের সাথে এবং লেখালেখির সাথে জড়িত তাদের সবার সম্পর্কেই আমাদের মনে একটা ধারণা আছে। এই ধারণার বাইরে গিয়ে যখন কোন লেখক নিজেকে আলোচিত করার মহান চেষ্ঠায় (‘চেষ্টা’ হবে) ব্রতী হন তখন আমাদের মতো পাঠকের মনে কষ্ট হয়।” এভাবেই তিনি বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন ইকবাল কাগজীকে।

ইকবাল কাগজী যে ভাষায় লিখেছেন তা অন্যলোকের ভাষা নয়। এই বদ্বীপেরই ভাষা। বাংলা অভিধানে শত বছর আগেই যার উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। আমাদের ভাষাজ্ঞান, শব্দজ্ঞান, ব্যাকরণজ্ঞান কম বলেই আমাদের কাছে ‘কঠিন’ মনে হয়। এখানে এই সত্যটি স্মরণ করা অনিবার্য যে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধকাব্য’-এর চেয়ে পৃথিবীতে সুবোধ্য গ্রন্থ কমই আছে। কিন্তু আমাদের অল্পবিস্তর শব্দ-শব্দার্থজ্ঞানের কারণে এই সুবোধ্য গ্রন্থটিও দুর্বোধ্য ঠেকে। ফলে এই মহৎ গ্রন্থটি মুষ্ঠিমেয় মননশীল পাঠক ব্যতীত অধিকাংশ পাঠকের পাঠের বাইরেই থেকে গেছে।

স্বনামধন্য অধ্যক্ষ মহোদয় বারবার ব্যক্তি কাগজীকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে গিয়ে স্বীয় দুর্বলতা ও অজ্ঞতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, প্রকারান্তরে নিজেকেই প্রমাণ করেছেন অজ্ঞ। ভুল বানানে প্রতিক্রিয়া লিখেছেন তিনি। লিখেছেন ‘পত্রিকায় কারো নাম বা পদবী মুদ্রণজণিত কারণে (‘মুদ্রণজণিত কারণে’ শব্দবন্ধটি একটি বহুল পরিচিত ভুল) ভুল ছাপা হলে তাতে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্মান কমে যায় না। কারণ সম্মান বাজারে কেজি দরে বিক্রি হয় না। উল্লেখ্য যে শিরোনামের লেখক (‘শিরোনামের লেখক’! আবার কী?) শ্রদ্ধেয় ইকবাল কাগজী কিছুদিন পূর্বে একটি স্থানীয় দৈনিকে কর্মরত অবস্থায় তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ছিলো পত্রিকার শব্ধ (‘শব্ধ’!) ভুল শুদ্ধ যাচাই বাছাই করা। দায়িত্ব পালনকরা অবস্থায় ঐ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যায় তিনি যে বড় ধরণের শব্দ (কী? ‘বড় ধরণের শব্দ’!) বাচাই (‘বাচাই’! শব্দটির অর্থ কী?) করে দিয়েছিলেন তা আজ তাঁর সম্মানের দিক বিবেচনা করে লেখা থেকে বিরত রইলাম।” এভাবেই বারবার তিনি লেখায় ‘গুত্তা’ দিতে কার্পণ্য করেননি। আমরা জানি অধ্যক্ষ মহোদয় যে স্থানীয় দৈনিকটিতে ইকবাল কাগজীর কাজের অভিজ্ঞতার বিষয় অবতারণা করেছেন, সেখানে তিনি (ইকবাল কাগজী) যে ‘বড় ধরণের শব্দ বাচাই’ করার ‘বড় ধরণের’ কাজে ব্যাপৃত ছিলেন, তা আমাদের জানা ছিল না, জেনে ধন্য হলাম। কিন্তু বিষয়টি অদ্ভুত ঠেকছে।

অধ্যক্ষ মহোদয় প্রস্তুতি নিয়ে লিখলে একটি ভাল লেখা পাওয়া যেত, আমরা নতুনরা ঋদ্ধ হতাম। গুণমুগ্ধ পাঠকরাও উপকৃত হতেন। কারণ সাহিত্য বিষয়ক প্রতিক্রিয়া পাঠ আগ্রহী পাঠকের জানার দরজা খুলে দেয়। নতুন লেখকরা উজ্জীবিত হয়। প্রতিক্রিয়া তাদের ভেতরে দ্রোহের দাবানল জ্বালিয়ে দেয়। ভারতের দেশ কিংবা আনন্দ বাজার পত্রিকায় এরকম জ্ঞানগর্ভ প্রতিক্রিয়া আমরা প্রায়ই দেখি। কিছুদিন আগে আমরা এমন ধারালো, সুখপাঠ্য ও সুন্দর প্রতিক্রিয়া দেখেছি বাংলাদেশের সাহিত্যকাগজ ‘নতুন ধারায়’। সেখানে লেখক-সমালোচকেরা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, ব্যাকরণ, বাংলা বানান ইত্যাদি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। লেখাগুলো পাঠকের কাছে যেমন উপভোগ্য ছিল, তেমনই জ্ঞান প্রসারে সহায়ক। ‘পাঠক প্রতিক্রিয়া’-র লেখক সেই সুযোগ থেকেও পাঠকদের বঞ্চিত করেছেন।

কবি আবু হাসান শাহরিয়ার ‘কবিতার বীজতলা’ কবিতাবিষয়ক গদ্যগ্রন্থে লিখেছেন “এজরা পাউন্ড যাদের ‘শূয়র’ বলে গালি দিয়েছেন, আমি তাদের ‘বামন’ ডাকি। বাংলা কবিতায় এখন পাউন্ডের ‘শূয়র’ আর আমার ‘বামন’দেরই দৌরাত্ম্যকাল। এদের কীটের স্বভাব- কুণ্ডলীতেই বংশপরিচয়; গোষ্ঠীকুণ্ডলী, দশককুণ্ডলী, মিডিয়াকুণ্ডলী পাকিয়ে দলে-দলে টিকে থাকে।’’ এই কুণ্ডলী পাকানোর চিরন্তন স্বভাবই প্রকাশ পেয়েছে আমাদের অধ্যক্ষ মহোদয়ের ‘পাঠক প্রতিক্রিয়া’-র বর্ণে-বাক্যে-ভাবার্থে-ভঙ্গিতে। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের অনুকরণে যাকে বলা যায় একাডেমিকুণ্ডলী!

শেষ করছি কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা দিয়ে-

‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু।’

আপনার মন্তব্য