বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ২৮-২৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-১১ ০১:১১:০৭

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২৮
মাথার উপরে র্যা কে ভারী সুটকেসটা রেখে, দুই পায়ের মাঝখানে কারেনিনকে নিয়ে ট্রেন কম্পার্টমেন্টের এক কোনায় চাপাচাপি করে বসা তেরেজার বার বার মায়ের সাথে থাকার সময় তার পুরাতন কর্মস্থলের সেই হোটেলের রেস্টুরেন্টের বাবুর্চির কথাই ভাবতে থাকে ; সেই বাবুর্চিটা যখনই সুযোগ পেয়েছে, তেরেজার নিতম্বে হাত ছুঁইয়েছে এবং সবার সামনে কখনোই যে জিজ্ঞাসা করতে ক্লান্ত হয়নি, কবে তেরেজা তার কথা মেনে নেবে আর তার শয্যাসঙ্গিনী হবে। ব্যাপারটা অদ্ভুত, তেরেজার তার কথাই মনে আসলো; সবসময়ই তেরেজা যা কিছু মনে প্রাণে ঘৃণা করে তার একটি শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ ছিল সেই লোকটি। আর এখন সে শুধুমাত্র যা ভাবতে পারছে তা হলো, তাকে খুঁজে বের করে বলবে, ‘তুমি তো আমার সাথে শুতে চাইতে, বেশ, আমি এসেছি’।

এমন কিছু করার জন্য তার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছিল, যা টমাসের কাছে তার আবার ফিরে যাওয়াটা চিরতরে ঠেকাতে পারে। তেরেজা তার  জীবনের এই অতীত সাতটা বছর নৃশংসভাবে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এটি ছিল সেই ভার্টিগো, সেই মত্ত, অনতিক্রম্য পতনের তীব্র ইচ্ছা।

আমরা এটাও হয়তো বলতে পারি, ভার্টিগো হচ্ছে দুর্বলদের নেশায় মত্ত হবার মত একটি অবস্থা। মানুষ তার দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে পরাজয় মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তার দুর্বলতায় সে তখন নেশাগ্রস্থ, সে আরো দুর্বলতার হতে চায়, সবার সামনে মূল চত্বরে সে পতিত হতে চায়, আরো নীচে, নীচ থেকেও আরো নীচে।

মনে মনে সে ঠিক করেছিল প্রাহা শহরেরে বাইরেই সে থাকবে, তার ফটোগ্রাফারের পেশাও সে ছেড়ে দেবে, সে তার সেই ছোট শহরে পালিয়ে যাবে, যেখান থেকে টমাসের কণ্ঠস্বর একসময় প্রলোভন দেখিয়ে তাকে বের করে এনেছিল।

কিন্তু প্রাহাতে আসার পর সে বুঝতে পারলো, এখানে কিছু সময় তাকে থাকতেই হবে, বেশ কিছু প্রায়োগিক বিষয়ের সমাধান করার জন্য, যা তার শহর থেকে প্রস্থানের ব্যাপারটাও প্রলম্বিত করে যাচ্ছিল।

পঞ্চম দিনে, হঠাৎ করে টমাস এসে উপস্থিত হয়, কারেনিন তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সুতরাং বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছে, তাদের নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করতে।

তারা অনুভব করেছিল যেন বরফ ঢাকা কোনো মাঠের মাঝখানে তারা দাড়িয়ে আছে, ঠাণ্ডায় কাঁপছে।

তারপর তারা দুজনে একসাথে পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে, এর আগে কোনদিনও চুমু খায়নি এমন প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের মতো।

টমাস জানতে চায়, ‘সবকিছু ঠিক আছে তো?’

তেরেজার উত্তর ছিল, ‘হ্যাঁ’।

‘তুমি তোমার আগের ম্যাগাজিনের ওখানে গিয়েছিলে’?

‘আমি ওদের ফোন দিয়েছিলাম’,

‘তারপর?’

‘না, এখনও উত্তর পাইনি, আমি অপেক্ষা করছি’।

‘কিসের জন্য’?।

তেরেজা এর কোন উত্তর দেয়নি। সে তো টমাসকে বলতে পারেনা যে, তার জন্য সে অপেক্ষা করছিল।

২৯
এবার আমরা ফিরে যাই সেই মুহূর্তে, যার সম্বন্ধে আমরা আগে থেকেই জানি। টমাস হতাশাজনক ভাবে অসুখী এবং তার পেটে খুব ব্যথাও করছিল। অনেক রাত না হওয়া অবধি সে ঘুমাতে পারেনি।

এর পরপরই তেরেজা জেগে যায়, (প্রাহার আকাশে রুশ যুদ্ধ বিমানের পাহারা ছিল সেই সময়ের নৈমিত্তিক ব্যাপার, আর সেই বিকট শব্দের কারণে ঘুমানো ছিল প্রায় অসম্ভব); তার প্রথম চিন্তা ছিল, টমাস ফিরে এসেছে শুধু তার কারণেই, শুধু তারই কারণে, তেরেজা তার নিয়তিকে বদলে দিয়েছে, এখন টমাস আর তার জন্য দায়ী না, এখন তেরেজাই তার সবকিছুর জন্য দায়ী।

সে অনুভব করেছিল, তার যতটুকু শক্তি আছে এই দায়িত্বটি পালনের জন্য তার চেয়ে আরো বেশী শক্তি তার দরকার।

কিন্তু প্রায় একই সাথে তার মনে পড়লো, আগের দিন তাদের ফ্ল্যাটের দরজায় টমাস এসে উপস্থিত হবার ঠিক আগ মূহুর্তে, গির্জার ঘণ্টায় ছয়টা বাজার ধ্বনি। যেদিন তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, তার কাজের শিফটও শেষ হয়েছিল ছয়টায়, তার সামনে হলুদ বেঞ্চের উপর টমাসকে সে বসে থাকতে দেখেছিল, তখনও সে শুনেছিল গির্জার ঘণ্টায় ছয়টা বাজার সংকেত।

না,এটা কোনো কুসংস্কার নয়, এটাই ছিল তার সৌন্দর্যবোধ, যা তার হতাশাকে নির্মূল করতে পেরেছিল এবং নতুন করে বাঁচার ইচ্ছায় তাকে পূর্ণ করে তুলতে পেরেছিল। ডানা ঝাপটানো দৈব ঘটনার পাখিরা আরো একবার তার কাঁধে জায়গা নেয়। তার চোখে তখন অশ্রু এবং  পাশে শোয়া টমাসের নিশ্বাসের শব্দে সে ‍অনির্বচনীয়ভাবে সুখী।
[চলবে..]

 দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত

আপনার মন্তব্য