বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৩.১

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-২০ ১৩:১১:৩৬

 আপডেট: ২০১৬-০৩-২২ ০১:২৮:২১

কাজী মাহবুব হাসান:

৩ -১
ভুল বোঝা শব্দগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান
নারী:
নারী হয়ে জন্মানোর নিয়তি সাবিনা নিজে নির্বাচন করেনি। যা আমরা নিজেরা নির্বাচন করিনি, তা আমরা আমাদের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা হিসাবে চিহ্নিত করতে পারিনা। সাবিনা বিশ্বাস করতো  অনির্বাচিত নিয়তির প্রতি তার সঠিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিৎ। নারী হয়ে জন্ম নেবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা তার কাছে মনে হয়েছে নারী হিসাবে জন্ম নেবার কারণে গর্ব করার মত একই রকম নির্বুদ্ধিতা।

একবার তাদের প্রথম একসাথে কাটানোর সময়ের একটিতে, ফ্রান্জ তাকে বলেছিল, কিছুটা অদ্ভুত জোরালোভাবে, সাবিনা, তুমি একজন ‘নারী’। সাবিনা বুঝতে পারেনি, কেন এই সুস্পষ্ট বিষয়টাকে সে এতই তীব্রভাবে প্রকাশ করছে - অনেকটাই কলম্বাসের সেই গভীরতা নিয়ে যখন সে প্রথম দিগন্তরেখায় স্থলের আভাস পেয়েছিল। অনেক পরে সাবিনা ফ্রান্জের ব্যবহৃত নারী শব্দটির অর্থ বুঝতে পেরেছিল, যার উপর সে অস্বাভাবিক একটি জোর দিয়েছিল। তার দৃষ্টিতে নারী শব্দটি, মানুষের দুটি লিঙ্গর একটিকে ইঙ্গিত করছে না, এটি প্রতিনিধিত্ব করছে একটি ‘মূল্যবোধের’, সব নারী নারী হিসাবে চিহ্নিত হবার যোগ্যতা রাখেনা। কিন্তু যদি সাবিনা, ফ্রান্জের দৃষ্টিতে, একজন নারী হয়ে থাকে, তাহলে তার নিজের স্ত্রী, মারি-ক্লদ কি? বিশ বছরের বেশী সময় আগে, মারি-ক্লদের সাথে ফ্রান্জের দেখা হবার বেশ কয়েকমাস পরেই, মারি-ক্লদ আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিল, যদি ফ্রান্জ তাকে কখনো ছেড়ে চলে যায়। ফ্রান্জ মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিল এই হুমকিতে। যদিও মারি-ক্লদের প্রতি বিশেষভাবে কোনো ভালোবাসা সে অনুভব করেনি ঠিকই, কিন্তু মারি-ক্লদের ভালোবাসার প্রতি সে তীব্র একটি আকর্ষণ অনুভব করেছিল। এধরনের কোনো বড় মাপের ভালোবাসা জন্য সে নিজেকে যোগ্য অনুভব করেনি, এবং সে অনুভব করেছিলো, মাথা নত করে মারি-ক্লদকে সম্মান প্রদর্শন করার ঋণটিকে।

এবং সে এতটাই নত হয়েছিলো যে সে তাকে বিয়েও করেছিল। এবং এমনকি যদিও মারি-ক্লদ আর কখনোই সেই আবেগময়তার তীব্রতা পুনরুদ্ধার করতে পারিনি, যার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল তার আত্মহননের হুমকি, তারপরও তার হৃদয়ে সেই স্মৃতিটাকে ফ্রান্জ জাগিয়ে রেখেছিল সেই ভাবনায় যে, সে অবশ্যই কখনোই তাকে কষ্ট দেবেনা এবং সবসময় তার ভিতরের নারীটিকে শ্রদ্ধা করবে।

বেশ অদ্ভুত একটি সূত্রবদ্ধকরণ। মারি-ক্লদকে সম্মান নয়, কিন্তু মারি-ক্লদের ভিতরে থাকা নারীটিকে সম্মান।

কিন্তু মারি-ক্লদ যদি নিজেই একজন নারী হয়ে থাকে, তাহলে তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা সেই অন্য নারীটি কে, যাকে ফ্রান্জের সবসময়ই শ্রদ্ধা করতে হবে? হয়তো, কোনো নারীর একটি প্লেটোনিক আদর্শ?

না, তার মা। এমন কিছু বলার জন্য যে তার কখনোই মনে হবেনা যে সে তার মায়ের ভিতরের নারীটিকে শ্রদ্ধা করে। সে তার মাকে উপাসনা করতো, তার ভিতরে বাস করা কোনো নারীকে নয়। তা মা এবং নারীত্বের প্লেটোনিক আদর্শ ছিল একটি এবং একই।

যখন তার বয়স বারো, ফ্রান্জের বাবা তাদের পরিত্যাগ করার পর হঠাৎ করেই তার মা নিজেকেই একাকী আবিষ্কার করেছিলেন। বালক ফ্রান্জ সন্দেহ করেছিল গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু তার মা সেই নাটকটিকে শব্দহীন করেছিলেন মৃদু আর নীরস শব্দাবলী দ্বারা যেন সেগুলো ফ্রান্জকে অস্থির না করে। যেদিন তার বাবা চলে গেলেন, ফ্রান্জ ও তার মা একসাথে শহরে বেড়াতে বের হয়েছিলেন, এবং যখন তারা ঘর থেকে বের হচ্ছে ফ্রান্জ লক্ষ্য করেছিল তার মায়ের পায়ের জুতাগুলো মিলছে না, সে নিজেই দ্বন্দ্বে আক্রান্ত হয়, সে চেয়েছিল তার মাকে ভুলটা দেখিয়ে দিক, কিন্তু ভয় পেয়েছিল এই কথাগুলো হয়তো তাকে কষ্ট দিতে পারে। সুতরাং  একসাথে শহরের রাস্তাগুলোয় দুই ঘণ্টা হাটার সময় সে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল তার মায়ের পায়ের দিকে। তখনই কেবল সে প্রথমবারের মত অনুভব করেছিল, কষ্ট পাবার মানে কি হতে পারে।

বিশ্বস্ততা এবং বিশ্বাসঘাতকতা:
শৈশব থেকেই সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা অবধি তার মাকে ভালোবেসে এসেছে ফ্রান্জ। তার স্মৃতিকেও সে ভালোবাসে। আর সেটাই তাকে অনুভব করিয়েছে, বিশ্বস্ততা, সদগুণগুলোর মধ্যে গর্বিত একটি জায়গা দাবী করতে পারে: বিশ্বস্ততা জীবনে একটি একতা নিয়ে আসে, নতুবা জীবন ক্ষণকালীন মূহুর্তব্যাপী প্রভাবের হাজার টুকরো ছিটকে পড়তো।

প্রায়ই সাবিনার কাছে ফ্রান্জ তার মায়ের গল্প বলেছে, এমনকি হয়তো একটি সুনির্দিষ্ট অবচেতন গোপন উদ্দেশ্য সহ: ফ্রান্জ মনে করেছিল তার বিশ্বস্ত থাকার যোগ্যতা প্রদর্শন করে সে সাবিনাকে মুগ্ধ করতে পারবে, সাবিনাকে পুরোপুরি জয় করার এটি একটি উপায় হতে পারে।

তবে সে যেটা জানতো না তা হলো সাবিনা বিশ্বস্ততা না, বিশ্বঘাতকতায় আরো বেশী মুগ্ধ হতো। বিশ্বস্ততা শব্দটি সাবিনাকে তার বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়, মফস্বল শহরের শুদ্ধবাদী একজন মানুষ, যিনি তার রোববারগুলো কাটাতেন জঙ্গলের সূর্যাস্ত আর ফুলদানীতে রাখা গোলাপফুল একে। তার কল্যাণে, যদিও শৈশবে সাবিনা ড্রইং করতে শিখেছিল। তার যখন চৌদ্দ, সাবিনা সমবয়সী একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল। তার বাবা এত বেশী শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি সাবিনাকে একটি বছর একা একা বাসার বাইরে বের হতে দেননি। একদিন তার বাবা তাকে পিকাসোর কিছু কাজের প্রিন্ট দেখিয়েছিলেন এবং সেটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছিলেন। সে যদি চৌদ্দ বছর বয়সী স্কুল ছাত্রকে ভালো না বাসতে পারে, অন্ততপক্ষে সে তো কিউবিজমকে ভালোবাসতে পারে। স্কুল শেষ করার পর, সাবিসা প্রাহাতে এসেছিল তীব্র আনন্দের একটি অনুভূতি নিয়ে, এখন অবশেষে সে তার বাড়ীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে।

বিশ্বাসঘাতকতা - খুব অল্প বয়স থেকে বাবা এবং শিক্ষকরা আমাদের শিখিয়েছেন -হচ্ছে কল্পনা করা সম্ভব এমন সবচেয়ে জঘন্যতম একটি অপরাধ। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা আসলে কি? বিশ্বাসঘাতকতা মানে দলের সবার সাথে ভিন্ন মত পোষণ করা এবং অজানার অভিমুখে যাত্রা। আর অজানার অভিমুখে যাত্রা করার মত আর কোনো কিছুই অসাধারণ ছিল না সাবিনার কাছে।

যদিও অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের একজন শিক্ষার্থী কিন্তু তার কোনো অনুমতি ছিলনা পিকাসোর মত চিত্রকর্ম সৃষ্টি করার জন্য। এটি ছিল সেই সময় যখন তথাকথিত সামাজিক বাস্তবতাবাদের ব্যবস্থাপত্র দেয়া হতো এবং স্কুলও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রনেতাদের প্রতিকৃতি উৎপাদন করতো।  বিশ্বাসঘাতকতা করার তার সেই কামনাটি বরং অপূর্ণই রয়ে গেছে:  তার কাছে কমিউনিজম শুধুমাত্র বরং আরো একটি বাবার মত, সমভাবেই যে কঠোর আর সীমিত।একজন বাবা যে তার ভালোবাসা আর পিকাসোকেও নিষিদ্ধ করেছে (সেই সময়টা ছিল গোঁড়া মতবাদের)। এবং যদি সে দ্বিতীয় শ্রেণীর কোনো অভিনেতাকে বিয়ে করে থাকে, তার কারণ শুধুমাত্র তারও ক্ষ্যাপাটে হিসাবে পরিচয় ছিল এবং দুই বাবার কাছেই যা অগ্রহণযোগ্য।

এরপর সাবিনার মা মারা যান। শেষকৃত্যে অনুষ্ঠান শেষে প্রাহাতে ফিরে আসার পর, সে একটি টেলিগ্রাম পায় যে তারা বাবাও আত্মহত্যা করেছেন দুঃখ সহ্য করতে না পেরে। হঠাৎ করেই সে বিবেকের দংশন অনুভব করে: আসলেই কি এত বেশী ভয়ঙ্কর ছিল তার বাবার সবসময় গোলাপ ভরা ফুলদানী আঁকা আর পিকাসোকে ঘৃণা করাটা? আসলেই কি বিষয়টি এতই ঘৃণ্য ছিল বাবার ভয়টা, যে তার চৌদ্দ বছরের মেয়ে গর্ভবতী হয়ে ঘরে ফিরতে পারে? আসলেই কি বিষয়টি এতটাই হাস্যকর যে, তিনি তার স্ত্রী ছাড়া বেঁচে থাকার কোনো তাড়না বোধ করেননি?

আবারো সে বিশ্বাসঘাতকতা করার তীব্র তাড়না অনুভব করে: তার নিজের বিশ্বাসঘাতকতার সাথে আবার বিশ্বাসঘাতকতা করার। সে তার স্বামীকে জানায় ( যাকে সে তখন পাগলাটে খামখেয়ালীর চেয়ে বরং ঝামেলাপূর্ণ  মাতাল হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল) সে তাকে ছেড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আমরা যদি ‘খ’ এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি, যার জন্য আমরা ‘ক’ এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম একদিন, এর মানে কিন্তু এই না যে আমরা ‘ক’ কে তুষ্ট করেছি। তালাকপ্রাপ্তা কোনো চিত্রকরের জীবন কোনোভাবে তার পিতামাতার জীবনের সাথে সদৃশ নয় ঠিকই, যাদের প্রতি সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। প্রথম বিশ্বাসঘাতকতাটি অপরিবর্তনীয়। এটি ভবিষ্যতে ধারাবাহিকভাবে আরো বহু বিশ্বাসঘাতকতাকে আমন্ত্রণ জানায়, যাদের প্রতিটি আমাদের মূল বিশ্বাসঘাতকতাকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য