বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৫.১

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-৩০ ২২:৪২:৪৪

কাজী মাহবুব হাসান:

৫.১
ভুল বুঝা শব্দগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান (ক্রমশ)

প্যারেড
ইতালি এবং ফ্রান্সের মানুষদের জন্য বিষয়টি সহজ । যখন তাদের পিতামাতা তাদের বাধ্য করেছে চার্চে যাবার জন্য, তারা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল পার্টিতে যোগ দিয়ে ( কমিউনিস্ট, মাওবাদী, ট্রটস্কিবাদী ইত্যাদি.)।সাবিনা, যদিও তাকে চার্চে প্রথম পাঠিয়েছিল তার বাবা, তারপর তিনিই আবার সাবিনাকে জোর করে বাধ্য করেছিলেন কমিউনিস্ট ইয়ুথ লীগের প্রতিটি সভায় যোগ দেবার জন্য। সাবিনা কমিউনিস্ট  ইয়ুথ লীগ এড়িয়ে চললে কি হতে পারে সেটা ভেবেই তিনি শঙ্কিত ছিলেন।

বাধ্যতামূলক মে দিবসের প্যারেডে সবার সাথে যখন কুচকাওয়াজ করতে হতো সাবিনাকে, কখনোই সে সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে পারেনি এবং লাইনে তার পেছনে মার্চ করা মেয়েটি চিৎকার করতো আর ইচ্ছা করেই তার গোড়ালিতে জুতা দিয়ে আঘাত করতো। যখন গান গাইবার সময় আসতো, তার কখনোই গানের কথা মনে থাকতো না, শুধুমাত্র মুখ খোলা আর বন্ধ করা ছাড়া সে কিছুই করতো না। কিন্তু অন্য মেয়েরা ঠিকই তাকে লক্ষ্য করতো এবং যথারীতি তার নামে নালিশও দিতো। তারুণ্য থেকেই সাবিনা প্যারেড ঘৃণা করে এসেছে।

ফ্রান্জ পড়াশুনা করেছিল প্যারিসে, যেহেতু সে অসাধারণ মেধাবী, তার পেশা বহু আগে থেকেই সুনিশ্চিত ছিল। তার বিশ বছর বয়সেই সে জানতো,  সে তার বাকী জীবন কাটাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসের সীমানায়, একটি বা দুটি লাইব্রেরীতে কিংবা দুই বা তিনটি লেকচার হলে। এমন কোনো জীবনের কথা ভাবলে তার শ্বাসরুদ্ধ হবার মত একটি অনুভূতি হতো। সেই জীবনের বাইরে বের হবার জন্য সে তীব্রভাবে কামনা করতো ঠিক যেমন করে বাসা থেকে মানুষ রাস্তার দিকে পা বাড়ায়।

এবং যতদিন সে প্যারিসে বাস করেছে, সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিবাদ মিছিলে সে অংশ নিয়েছিল। কত অসাধারণ আনন্দের ছিল কোনো কিছু উদযাপন করা, দাবী করা, প্রতিবাদ করা; বাইরে বের হয়ে আসা, সবার সাথে  একসাথে মিছিল জমায়েত করা। বুলেভার্ড সন্ত জেরমাঁ থেকে অথবা প্লাস দো লা রিপাবলিক থেকে বাস্তিল অবধি মানুষের মিছিল তাকে তীব্র আকর্ষণ করতো। মিছিল আর চিৎকাররত জনতাকে সে দেখতো ইউরোপ ও তার ইতিহাসের একটি ছবি হিসেবে। পুরো ইউরোপই হচ্ছে  সুবিশাল মিছিলের মত। একটি বিপ্লব থেকে আরেকটি বিপ্লবের দিকে মিছিল, একটি সংগ্রাম থেকে আরেকটি সংগ্রাম, সর্বদা সম্মুখ বরাবর।

আমি হয়তো অন্যভাবে বলতে পারি, ফ্রান্জ তার বইয়ের জীবনকে মনে করতো অবাস্তব, সত্যিকারের জীবন সে কামনা করতো, তার পাশাপাশি হাটা মানুষের স্পর্শ পেতে চাইতো..তাদের চিৎকার শুনতে চাইতো। তার কখনো মনে হয়নি যা সে অবাস্তব মনে করছে (অফিস কিংবা লাইব্রেরীর নির্জনতায় আসলে যে কাজগুলো সে করে) বাস্তবিকভাবেই তার সত্যিকারের জীবন, আর যে প্যারেডগুলোকে সে বাস্তবতা হিসাবে কল্পনা করছে, তারা থিয়েটার,নাচ, কার্নিভাল ছাড়া আর কিছু নয় - অন্যার্থে - একটি স্বপ্ন।

তার শিক্ষাজীবনে সাবিনা হোস্টেলেই থাকতো। মে দিবসে সব শিক্ষার্থীরাই বাধ্য ছিল প্যারেডের জন্য খুব সকালে হাজিরা দেবার জন্য। কর্মকর্তারা সারা বিল্ডিং চিরুনির মত আঁচড়ে খুঁজে বের করতেন কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা, নিশ্চিত হতেন কেউ যেন অনুপস্থিত না থাকে। সাবিনা লুকিয়ে থাকতো টয়লেটে। পুরো বিল্ডিং খালি হবার অনেক পরেই কেবল বের হয়ে এসে তার রুমে ফিরে যেত। তার মনে পড়েনা সেই ঘরের নীরবতার মত আর কোনো নীরবতা সে আর কখনো অনুভব করেছে । বহু দুর থেকে ভেসে আসা প্যারেডের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অনেকটাই যেন সে একটি ঝিনুকের খোলসের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছে এবং শুধুমাত্র যে শব্দ সে শুনতে পারছে সেটি বাইরের সেই বৈরী বিশ্বের সমুদ্রের।

প্রবাসে আসার এক বা দুই বছর পর, তার দেশে রুশ আগ্রাসনের একটি বার্ষিকীতে সে ঘটনাচক্রে প্যারিসে ছিল। প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল সেই উপলক্ষে, আর সেও কিছুটা তাড়না বোধ করেছিল সেই মিছিলে যোগ দেবার জন্য। বজ্রমুষ্টি হাত উপরে তুলে তরুণ ফরাসীরা সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান দিচ্ছে, শ্লোগানগুলো তার ভালো লাগছিল কিন্তু বিস্ময়করভাবে সে কিছুতেই পারছিল না তাদের শ্লোগানে গলা মেলাতে। অল্প কিছু সময়ের বেশী সে আর মিছিলে থাকতে পারেনি।

বিষয়টি যখন সে তার ফরাসী বন্ধুদের বলেছিল, তারা বিস্মিত হয়েছিল। তার মানে তুমি কি তোমার দেশে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাওনা? সে তাদের বলতে চাইছিল যে, কমিউনিজম, ফ্যাসিজম এবং সব ধরনের দখল আর আগ্রাসনের পেছনে লুকিয়ে থাকে আরো বেশী মৌলিক, সর্বব্যাপী অশুভ একটি বিষয়, এবং সেই অশুভ বিষয়টির চিত্র হচ্ছে, একটি প্যারেড যেখানে বাতাসে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে মিছিল করছে মানুষ, চিৎকার করে শ্লোগান দিচ্ছে একসাথে, হুবহু এক সুরে এবং সে জানতো, কোনোদিনও সে তার ফরাসী বন্ধুদের সেটি বোঝাতে পারবে না। বিব্রত হয়ে, সে বিষয়টি পরিবর্তন করেছিল।

নিউ ইয়র্কের সৌন্দর্য
সাবিনা ও ফ্রান্জ নিউ ইয়র্কের রাস্তায় বহু ঘণ্টা ধরে একসাথে হেঁটেছে। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়েছে, যেন তারা কোনো দৃষ্টিকাড়া প্রাকৃতিক দৃশ্য পরিবেষ্টিত আকা বাঁকা পাহাড়ি কোনো পথ ধরে হাঁটছে: একজন তরুণ ফুটপাথের মাঝখানে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছে; এর কয়েক পা দুরে সুন্দরী এক কৃষ্ণাঙ্গ রমণী গাছে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, কালো স্যুট পরা একটি মানুষ রাস্তা পার হবার সময় যেন কোনো এক অদৃশ্য অর্কেস্ট্রার সঙ্গীত পরিচালনা করছে হাত নাড়িয়ে, একটি ফোয়ারা থেকে বেরিয়ে আসছে পানি, তার প্রান্তে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে এক দল নির্মাণ শ্রমিক। কুৎসিত লাল দেয়াল সহ একটি ভবনের উপর থেকে নীচ অবধি বিস্তৃত অদ্ভুত লোহার মই, কুৎসিত সেই লাল দেয়াল এতই কদর্য যে সেটি সুন্দর।  এবং এর পাশেই, একটি সুবিশাল কাচের স্কাইস্ক্র্যাপার, যার পেছনেও একই রকম আরেকটি ভবন, যার উপরেই একটি ছোট আরবিয় প্রমোদ ভবন সদৃশ একটি দালান, গুম্বজ শৃঙ্গ, গ্যালারী, মিনা করা স্তম্ভসহ।

সাবিনাকে তার চিত্রকর্মের কথা মনে করিয়ে দেয় দৃশ্যগুলো। সেখানেও, বেমানান জিনিসগুলো একসাথে জড়ো হয়, একটি ইস্পাতের নির্মাণ কাঠামো, একটি কেরোসিনের বাতির উপর যা আরোপিত হয়ে আছে; একটি রঙ্গিন কাচের ঢাকনি সহ পুরোনা ফ্যাশনের বাতি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো হয়ে ভেঙে জলাভূমির নির্জন ভূদৃশ্যের উপর ভেসে আছে।

ফ্রান্জ বলেছিল,‘ ইউরোপীয় ভাবনায় সৌন্দর্যের সবসময়ই একটি পরিকল্পিত গুণ বা বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের সবসময়ই একটি নন্দনতাত্ত্বিক উদ্দেশ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা ছিল। সেকারণেই পশ্চিমা মানুষরা বহু দশক ব্যয় করতে পেরেছে কোনো একটি গথিক ক্যাথিড্রাল অথবা একটি রেনেসাঁ পর্বের পিয়াৎসা নির্মাণ করতে। নিউ ইয়র্কের সৌন্দর্য নির্ভর করে আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ভিত্তির উপর, যা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। মানুষের কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এটি স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে, কোনো স্ট্যালাগমাইট পূর্ণ গুহার মত। যে রূপগুলো যারা নিজেরাই যথেষ্ট কুৎসিত, কিন্তু কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই যারা দৈবাৎ এমন কোনো একটি অবিশ্বাস্য পরিবেশে জীবন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আকস্মিক বিস্ময়কর কাব্যময়তায়’।

সাবিনা বলেছিল, ‘কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই সৃষ্টি হওয়া সৌন্দর্য, হ্যাঁ, অন্য আরেকভাবে হয়তো এটাকে বলা যেতে পারে ‘ভুল করে সৃষ্টি হওয়া সৌন্দর্য’। এই পৃথিবী থেকে সৌন্দর্য পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যাবার পরও, এটি আরো কিছু দিন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে ভুল করেই’। ‘ভুল করে সৃষ্টি হওয়া সৌন্দর্য’ সৌন্দর্যের ইতিহাসে শেষ ধাপ।

এবং সাবিনা তার প্রথম পরিশীলিত প্রাপ্তবয়স্ক চিত্রকর্মটির কথা মনে করে, যা সৃষ্টি হয়েছিল কারণ কিছু লাল রঙ ভুল করে তার ক্যানভাসে পড়েছিল। হ্যাঁ, তার চিত্রকর্মগুলোর ভিত্তি ভুল করে সৃষ্টি হওয়া সৌন্দর্যে।এবং নিউ ইয়র্ক হচ্ছে তার চিত্রকর্মের গোপন কিন্তু অকৃত্রিম জন্মভূমি।

ফ্রান্জ বলে, ‘হয়তো নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্ট সৌন্দর্যে অনেক বেশী সমৃদ্ধ এবং আরো বেশী বৈচিত্রময় মানব পরিকল্পনায় সৃষ্ট অতিরিক্ত কঠোর সৌন্দর্যের চেয়ে। কিন্তু এটি আমাদের ইউরোপীয় সৌন্দর্য না, এটি ভিন্ন অচেনা একটি জগত’।

তাহলে কি তারা অবশেষে কোনো বিষয়ে একমত হতে পেরেছিলো?

না, পার্থক্য আছে কিছু, সাবিনা নিউ ইয়র্কের সৌন্দর্যের এই ভিন্নতার গুণের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছিল। ফ্রান্জের কাছে যা কৌতূহলোদ্দীপক কিন্তু শঙ্কা জাগানো, যা তাকে ইউরোপের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিমর্ষ করে তুলেছিল।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য