বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৫.২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-০৪ ২৩:৫৮:২২

কাজী মাহবুব হাসান:

৫.২
ভুল বোঝা শব্দগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান (চলমান)
সাবিনার দেশ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ফ্রান্জের বিতৃষ্ণাটি সাবিনা বুঝতে পেরেছিল। সে ইউরোপেই মূর্ত প্রকাশ: তার মায়ের জন্ম ভিয়েনায়, তার বাবা ফরাসী, সে নিজে সুইস।

সাবিনার দেশটির গুণমুগ্ধ একজন ভক্ত ছিল ফ্রান্জ। তার সাথে যখনই সাবিনা নিজের সম্বন্ধে কিংবা দেশের বন্ধুদের নিয়ে কথা বলেছে, ফ্রান্জ সেই শব্দগুলোই শুনতো, ‘জেলখানা’, ‘নির্যাতন’, ‘শত্রু সেনাদের ট্যাঙ্ক’,‘দেশত্যাগ’, ‘ইশতেহার’, ‘নিষিদ্ধ বই’, ‘নিষিদ্ধ প্রদর্শনী’, এবং স্মৃতিবেদনা আর ঈর্ষার অদ্ভুত মিশ্রিত একটি অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করতো। সাবিনার কাছে সে একটি স্বীকারোক্তিও করেছিলো - ‘একবার একজন দার্শনিক লিখেছিলেন, আমার কাজের সব কিছুই অপ্রমাণিত সব ধারণা এবং আমাকে তিনি ‘ছদ্ম-সক্রেটিস’ নামেও চিহ্নিত করেছিলেন। আমি খুবই অপমানিত বোধ করেছিলাম এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছিলাম। কিন্তু শুধুমাত্র চিন্তা করে দেখো, এই হাস্যকর পর্বটি হচ্ছে আমার জীবনে ঘটা সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ! আমার জীবনে বিদ্যমান সম্ভাব্য সব নাটকীয়তার শীর্ষ বিন্দু।আমরা দুজন দুটি ভিন্ন মাত্রায় বাস করছি, তুমি আর আমি। তুমি আমার জীবনে এসেছো গ্যালিভার যেমন লিলিপুটদের দেশে প্রবেশ করেছিল’।

সাবরিনা প্রতিবাদ করে বলেছিল যে এই সংঘর্ষ, নাটক এবং ট্রাজেডি সব অর্থহীন।কোনো বিশেষ অন্তর্নিহিত মূল্যও নেই এইসব কিছুর। এমন কিছুই নেই যা কিনা সম্মান বা প্রশংসা দাবী করার যোগ্য হতে পারে। যা সত্যি ঈর্ষার যোগ্য তা হলো ফ্রান্জের কাজ, আর সেই বাস্তব সত্যটা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তার আছে আছে, যেখানে সে নিজেকে পুরোপুরি নিবেদন করতে পারে তার কাজে।

ফ্রান্জ অসম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকিয়েছিল, ‘যখন কোনো একটি সমাজ ধনী, সেই সমাজের মানুষগুলোকে আর তাদের হাত দিয়ে কোনো কাজ করতে হয় না, তখন প্রাণশক্তি আর আত্মার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারে তারা। ক্রম বর্ধমান হারে আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। যদি তাদের কোনো ডিগ্রী অর্জন করতে হয়,  তাহলে তাদেরকে গবেষণার জন্য বিষয় নির্বাচন করতে হবে। এবং যেহেতু গবেষণা রিপোর্ট পৃথিবীর যে কোনো বিষয় নিয়েই লেখা যায়, সুতরাং বিষয়ের সংখ্যাও অসীম। শব্দ দিয়ে পূর্ণ কাগজের পৃষ্ঠা স্তূপ হয়ে জমে আছে আমাদের আর্কাইভগুলো, কোনো সমাধিক্ষেত্রের চেয়েও বেশী বিষণ্ণতা নিয়ে। কারণ সেগুলো কেউই আর পড়ে দেখে না। এমনকি অল সোলস ডে তেও *।অতি উৎপাদনে আমাদের সংস্কৃতি এখন ক্ষয়িষ্ণু, শব্দের বিধ্বংসী তুষারধ্বসে, পরিমাণের উন্মত্ততায়। সে কারণে তোমার প্রাক্তন দেশের একটি নিষিদ্ধ বই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উগরে দেয়া সহস্র কোটি শব্দের চেয়েও বেশী অর্থবহ’।

এই ভাবনায় বিপ্লবের প্রতি ফ্রান্জের দুর্বলতাটিকে হয়তো আমরা বুঝতে পারছি। প্রথমে সে সমব্যথী হয়েছিল কিউবার সাথে, তারপর চীন, পরে যখন সেখানে তাদের শাসকদের নিষ্ঠুরতা তাকে আতঙ্কিত করেছিল, সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল এক সমুদ্র পরিমাণে শব্দের প্রতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যাদের কোনো ওজন নেই এবং নেই জীবনের প্রতি কোনো সদৃশতা। জেনেভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সে একজন অধ্যাপকে পরিণত হয় ( যেখানে কোনো প্রতিবাদ মিছিল নেই) এবং আত্ম উৎসর্গের বিস্ফোরণে (রমনীহীন, মিছিলবিহীন নির্জনতায়) সে বেশ কিছু জ্ঞানগভীর বই প্রকাশ করেছিল, যাদের প্রত্যেকটি তাকে দিয়েছিল যথেষ্ট পরিমাণ খ্যাতি ও পরিচিতি। তারপর একদিন তার জীবনে এসেছিল সাবিনা। সাবিনা ছিল বিস্ময়কর একটি প্রকাশ, প্রতিবোধনের মত। সে এমন একটি দেশ থেকে এসেছিল যেখানে বিপ্লবী বিভ্রমগুলো বহুদিন আগেই ম্লান হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বিপ্লবের যে বিষয়গুলো ফ্রান্স বিশেষ পছন্দ করে সেগুলো তখনো সেখানে অবশিষ্ট ছিল: বড় মাত্রায় কাটানো জীবন, ঝুঁকি, সাহসী এবং মৃত্যুভয় পূর্ণ জীবন। মানব প্রচেষ্টার মহত্বের প্রতি তার বিশ্বাসকে পুননবায়ন করেছিল সাবিনা। সাবিনার উপর তার দেশের বেদনাপূর্ণ নাটকীয়তা আরোপণ করে, সাবিনার মধ্যে আরো বেশী সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিল ফ্রান্জ।

সমস্যা হচ্ছে যে সাবিনা সেই নাটকের প্রতি আদৌ কোনো প্রেম ছিল না। জেলখানা, নিগ্রহ, নিষিদ্ধ বই, আগ্রাসন, ট্যাঙ্ক শব্দগুলো তার জন্য কুৎসিত, সামান্যতম রোমান্সের চিহ্ন ছাড়া। একটি মাত্র শব্দ যা তার মনে জন্মভূমির একটি মধুর স্মৃতিবেদনার স্মৃতির উদ্রেক করতো, সেটি ছিল ‘সমাধিক্ষেত্র’।

সমাধিক্ষেত্র
বোহেমিয়া** সমাধিক্ষেত্রগুলো বাগানের মত । কবরগুলো আচ্ছাদিত ঘাস আর নানা রঙের ফুল দিয়ে। সাধারণ পাথরের সমাধিফলক সেখানে হারিয়ে যেত সবুজের মধ্যে। যখন সূর্য অস্তমিত হতো, পুরো সমাধিক্ষেত্র জ্বল জ্বল করে উঠেতো অসংখ্য ক্ষুদ্রাকৃতির জ্বলন্ত মোমবাতির আলোয়। মনে হতো যেন মৃতরা শিশুদের কোনো বল নাচের আসরে নাচছে। হ্যাঁ, শিশুদের বল নাচের আসর, কারণ মৃতরা শিশুদের মতেই নিষ্পাপ। জীবন যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন, সমাধিক্ষেত্রে সবসময়ই  রাজত্ব করে শান্তি। এমনকি যুদ্ধের সময়, হিটলারের সময়, স্টালিনের সময়, সব আগ্রাসনের সময়। যখনই মন খারাপ হতো, সাবিনা প্রাহা ছেড়ে বহু দুরে চলে যেত, এবং কোনো না কোনো এক গ্রামের সমাধিক্ষেত্রে একা একা হাটতো। খুব ভালোবাসতো সে সমাধিক্ষেত্রে এভাবে একা একা হাটতে। নীল পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে, তারা ঘুম পাড়ানিয়া গানের মতই সুন্দর।
ফ্রান্জের এর জন্য সমাধিক্ষেত্র পাথর আর অস্থির একটি কুৎসিত স্তূপ।

* অল সোলস ডে, খ্রিষ্টীয় ধর্মের এই দিনে শুধু নিজেদের স্বজন না, বিশ্বাসী সব প্রয়াত আত্মাদের স্মরণ করা হয় (নভেম্বর ২)।
** বোহেমিয়া ( চেক ভাষায় চেখি) চেক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি এলাকা।শব্দটি একটি বড় অর্থে পুরো চেক প্রজাতন্ত্রের  এলাকাকে বোঝায়।

আপনার মন্তব্য