বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-২২ ১২:৪৮:০৯

কাজী মাহবুব হাসান:


টমাস সবসময় চেষ্টা করতো তেরেজার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে তার বিছানায় বিশ্রাম নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে, যেন সে একা একা সকালের খাওয়াটা সারতে পারে। কিন্তু কখনোই তেরেজাকে সে রাজী করাতে পারেনি। টমাস কাজ করতো সকাল সাতটা থেকে বিকাল চারটা, আর তেরেজা বিকাল চারটা থেকে মধ্যরাত অবধি। যদি সে তার সাথে সকালের এই খাওয়াটাও বাদ দেয়, তাহলে শুধু রোববারগুলো ছাড়া আর তাদের মধ্যে আসলেই কোনো কথা হবার সুযোগ নেই। সে কারণে সে বিছানা ছেড়ে ওঠে, যখন টমাসও বিছানা ছাড়ে, পরে আবার বিছানায় ফিরে যায় টমাস কাজে বের হয়ে গেলে ।

তবে এই সকালে, আবার ঘুমিয়ে পড়তে তার ভয় হচ্ছিল, কারণ সকাল দশটায় জোফিন আইল্যান্ডের* সনায়** তার যাওয়ার কথা। যদিও বহু মানুষ সেখানে যাবার জন্য উদগ্রীব, তবে শুধুমাত্র অল্প কয়েকজনকেই সনাটি জায়গা দিতে পারে, সেখানে জায়গা পাবার একটা উপায় হচ্ছে কারো সাহায্য নেয়া। সৌভাগ্যক্রমে সেখানকার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ১৯৬৮ সালের পরে বহিষ্কৃত একজন অধ্যাপকের স্ত্রী, এবং এই প্রফেসর হচ্ছেন টমাসের এক প্রাক্তন রোগীর বন্ধু, টমাস তার রোগীকে বলেছিল, এবং সেই রোগী প্রফেসরকে বলেছিল, প্রফেসর তার স্ত্রীকে বলেছিল, এবং তেরেজা সপ্তাহে একদিন যাবার টিকিটও পেয়েছিল।

সেখানে সে হেটেই যেত, সার্বক্ষণিক ভিড়ে পূর্ণ ট্রামে চড়তে অপছন্দ করতো তেরেজা, যেখানে যাত্রীদের পরস্পরে ঘৃণাপূর্ণ আলিঙ্গনের দিকে নিরন্তর ধাক্কা সহ্য করতে হয়, পরস্পরের পা মাড়ানো, কোটের বোতাম ছেড়া আর চিৎকার আর গালমন্দ সে ঘৃণা করতো।

হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল তখন, দ্রুতবেগে হাটা মানুষগুলো তাদের মাথার উপর ছাতা খুলতে শুরু করেছিল। এবং একই সাথে সব রাস্তাও যেন আরো জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে। খিলানের মধ্যে বাঁকানো ছাতার ছাদগুলো পরস্পরের সাথে ধাক্কা খায়। পুরুষগুলো সৌজন্যবোধ দেখায়, যখন তারা তেরেজাকে পাশ কাটিয়ে যায়, তারা তাদের ছাতা আরো উঁচু করে ধরে যেন সে তার ছাতা নিয়ে যাবার জায়গা পায়। কিন্তু নারীরা কোনো মতেই তাদের জায়গা ছাড়ে না, প্রত্যেকের দৃষ্টি শুধু সরাসরি সামনের দিকে, সবাই যেন অপেক্ষা করছে কখন অন্য নারী তাদের নিজেদের হীনতা স্বীকার করে তার জন্য জায়গা করে দিতে পাশে সরে যাবে। ছাতাদের এই সাক্ষাতকার যেন তাদের শক্তি দেখানোর একটি পরীক্ষা। প্রথমে তেরেজা হার মেনে নেয়, কিন্তু যখন সে অনুধাবন করে যে, তার সৌজন্যতাবোধের কেউ প্রত্যুত্তর দিচ্ছে না, সেও অন্য নারীদের মত তার ছাতা আঁকড়ে ধরে, আরো তীব্রতা সহ সামনে আসা ছাতাগুলোর সাথে ধাক্কা দিয়ে সে পথ চলতে থাকে। কেউ কখনো এর জন্য দুঃখিত শব্দটি উচ্চারণ করেনা। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে কেউ কোনো কিছুই বলেনা। যদিও মাঝে মাঝে তার কানে ভেসে আসে ‘মোটা গাভী’ কিংবা আরো কিছু যৌনতা সংশ্লিষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করা শব্দ।

নারীরা যারা এভাবে তাদের ছাতায় সশস্ত্র হয়ে আছে তারা তরুণী কিংবা বয়স্ক, কিন্তু শুধুমাত্র তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণীরাই অপেক্ষাকৃত বেশী শক্তিশালী যোদ্ধা হিসাবে নিজেদের প্রমাণিত করে।তেরেজা রুশ আগ্রাসনের সেই দিনগুলোর কথা মনে করে, সেই সব মিনিস্কার্ট পরা তরুণীদের কথা মনে করে, যাদের হাতে লম্বা লাঠিতে বাধা পতাকা বাধা থাকতে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিল যৌন প্রতিশোধ: দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে রুশ সৈন্যদের জোরপূর্বক নারী সঙ্গ থেকে বঞ্চিত রাখা, তারা অবশ্যই হয়তো অনুভব করেছিল যেন কোনো নতুন গ্রহে এসে পড়েছে তারা, যা সৃষ্টি করেছে কোনো কল্প বিজ্ঞানের কাহিনী লেখক, দুর্দান্ত সব সুন্দরী নারীদের একটি গ্রহ, যারা তাদের অবজ্ঞা আর ঘৃণা তাদের সুন্দর দীর্ঘ পায়ের উপর বয়ে নিয়ে প্যারেড করে বেড়াচ্ছে, যে দৃশ্য গত পাঁচ অথবা ছয় শতাব্দীতে রাশিয়াতে কখনোই দেখা যায়নি।

এইসব তরুণীদের বহু ছবি তেরেজা তুলেছিল রুশ ট্যাঙ্কদের প্রেক্ষাপট হিসাবে ব্যবহার করে। তাদের প্রতিবাদী সাহসী রূপের কত বেশী সে প্রশংসা করেছে ! আর এখন সেই একই তরুণীরাই তাকে ধাক্কা দিচ্ছে, নিষ্ঠুরভাবে আর ঘৃণার সাথে।পতাকার পরিবর্তে, তারা ধরে আছে ছাতা, কিন্তু তারা সেটি একই অহংকার নিয়ে ধরে আছে। তারা দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত তাদের পথ না ছাড়তে অস্বীকার করা কোনো ছাতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে,যেমন করে তারা প্রস্তুত ছিল ভিনদেশী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য।

পাদটীকা:
* জফিন আইল্যান্ড - চেক প্রজাতন্ত্রে রাজধানী প্রাগ বা প্রাহায় ভলটাভা নদীর উপর ছোট একটি দ্বীপ, বহু আগে থেকে জায়গাটি জফিন প্যালেসের জন্য পরিচিত।প্রাগের সাংস্কৃতিক একটি কেন্দ্র
** সনা ( Sauna): স্টিম বাথ বা বাষ্পস্নান,
(চলবে)

আপনার মন্তব্য