কাজী নজরুল ইসলাম; অসামান্যতার খেরোখাতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-২৫ ১৪:১৫:০৪

মাসুদ পারভেজ :

২৫ মে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মবার্ষিকী।

নজরুল বাঙালীর মননশীলতার অনেকখানি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আছে। আজীবন সংগ্রামী এই কবির জীবনী যেন এক জিয়নকাঠি। মুহূর্তেই জেগে উঠে মন প্রাণ। মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চললেও নজরুল প্রাসঙ্গিক। নজরুলকে অনেক পরিচয়ে পরিচায়িত করা যায়। তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক, সৈনিক, সুরকার, সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ তো বটেই। অসংখ্য ধর্মীয় গীত রচনা করে নজরুল হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন জীবদ্দশায়। নজরুল কেমন ছিলেন সত্যিকার অর্থে, তেমনি কিছু বিষয় নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। তুলে ধরতে চেয়েছি অনেকাংশে কম জানা বা না জানা বিষয়গুলোকে।  

মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।  

কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ধূমকেতুর মত যার আগমন তিনি হচ্ছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সুরস্রষ্টা, সাংবাদিক, রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি, শিল্পী, সুরকার, প্রাবন্ধিক। নজরুলের কবিতায়, সাংবাদিকতায়, সঙ্গীতের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠেছে নিপীড়িত, বঞ্চিত, খেটে খাওয়া মানুষের কথা। তিনিই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। চির বিদ্রোহী এ কবির জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৫শে মে। নানান ঘাত প্রতিঘাতে ভরপুর কবির জীবন। কখনো রুটির দোকানের কর্মচারী আবার কখনো মসজিদের মুয়াজ্জিন আবার কখনো সৈনিক আবার কখনো গানের দলে আবার কখনো পাঠশালায়......... জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে তিনি উপলব্ধি করেছেন ভারতবর্ষের মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা, খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাধারণ মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা, ইংরেজদের দুঃশাসনে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

বিদ্রোহী কবির সম্পূর্ণ জীবনই এক বিস্ময়, অনেক বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যায়। তবে এ লেখায় চেষ্টা থাকবে অসাম্প্রদায়িকতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি সে বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে, সমালোচকদের ভাষায় নজরুল এবং কবির রাজনীতি ভাবনা  এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের সম্পর্ক বিষয়ে লিখতে।

নজরুল তার সমসাময়িকের মধ্যে একেবারে বিশুদ্ধ ধারার অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছিলেন। তিনি কবিতায় চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিমের মিলন ঘটাতে। সাম্যবাদী গ্রন্থের ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি অবলীলায় লিখেছেন –

গাহি সাম্যের গান –
মানুষের কাছে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাতের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
 সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে, তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
সত্যই তার কাছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ছিল না, ভেদাভেদ ছিল না জাত-পাতের।
সাম্যবাদী গ্রন্থের ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন –
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-ক্রিশ্চান।   

অনেকে বলে থাকেন নজরুলের ধর্ম বিশ্বাস আসলে কি। আবার অনেকে বলেন তিনি না কি শ্যামা পূজা করেছেন যদিওবা এ অভিযোগ হিন্দুরা করেন নি। তিনি একধারে হামদ-নাত, ইসলামি গজল যেমন লিখেছেন আবার তিনি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন। নজরুলের জবানেই দেখি তিনি কি বলেছেন - ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই ডিসেম্বর রবিবার কলিকাতা এলবার্ট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিপুল সমারোহ ও আন্তরিকতা সহকারে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সেখানে তিনি বলেন, “কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি”।   
 
এরপরেও যে সমালোচনা হয় নি তাও কিন্তু নয়, মুসলমানদের মাঝে অনেকে অভিযোগ করেন যে তিনি কাফের ছিলেন , বস্তুত তিনি বেশ কিছু কবিতায় ইসলামবিরোধী বেশ কিছু কাজের তীব্র সমালোচনা করেছেন, আবার তিনি মুসলিমদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন সাথে সাথে হিন্দুদের সাথেও সুসম্পর্ক স্থাপনের দিকেও জোর দিয়েছিলেন, এটার উজ্জ্বল উধাহরন- তিনি একাধারে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনেও সমর্থন দিয়েছিলেন আবার খিলাফত আন্দোলনেও সমর্থন দিয়েছিলেন। বস্তুত কবি চেয়েছিলেন শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলিম এক সাথে বসবাস করতে পারলে তাদের মাঝে ভেদাভেদ কেন থাকবে বরং তাদের মাঝে বেশ ভালো বোঝাপড়া হওয়ার ই কথা। তিনি  ইসলাম নামধারী ভণ্ডদের বিরুদ্ধে লিখেছেন –

মৌ-লোভী যত মোলভী আর মোল্লারা কন হাত নেড়ে
দেব-দেবী নাম মুখে আনে সবে তাও পাজীটার যাত মেরে।

কিন্তু কবির অভিযোগে সব আলেমদের কথা আসে নি কারন তিনি জানতেন সবাই এক রকম না, আলেমদের মাঝেও অনেকে আছেন যারা ভণ্ড নয়। আবার সেই তিনি লিখেছেন-

শিক্ষা দিয়ে দীক্ষা দিয়ে
…. ঢাকেন মোদের সকল আয়েব
পাক কদমে সালাম জানাই
….নবীর নায়েব, মৌলভী সাহেব।

এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে তিনি ভণ্ডদের মৌ –লোভী বলেছেন আবার মৌলভীদের পাক কদমে সালাম জানিয়েছেন। তিনি সকল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন, যেটা কবিতায় উত্তাপিত হয়েছে।
 
কবি হিন্দু ধর্ম বিষয়েও প্রচুর পড়াশোনা করেছেন, জানার জন্য, মিলনের জন্য। নজরুলের আশঙ্কা ছিল সবসময় যে হিন্দু মুসলিম ভাগ হয়ে যাবে, তাদের মধ্যে অবিশ্বাস থাকলে একসাথে থাকা সম্ভবপর হবে না, সেটার প্রতিফলন দেখতে পাই ১৯৪৭ সালে, শুধুমাত্র হিন্দু -মুসলিমের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গেল। নজরুলের সাবধানবাণী সত্যি হল বস্তুত নজরুল যেভাবে এটাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন অন্যরা এ বিষয়টাকে গুরুত্বই দেন নি। তিনি বলেছেন- “আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের কুসংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার সৌন্দর্যের হানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।”  

নজরুল রাজনীতিতে শুরুতে প্রকাশ্য না থাকলেও রাজনীতি সচেতন ছিলেন সচেতনভাবেই। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। সৈনিক জীবন ত্যাগ করে তিনি তৎকালীন সমাজতন্ত্রের পুরোধা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কবির উপস্থিতি ছিল শক্তিমান এবং শাসকদের জন্য যা ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। মুজফফর আহমদের সাথে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও বক্তৃতায় অংশ নিতেন। ১৯১৭ সালের রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে উদ্দীপিত করে দারুণভাবে। কবির বিভিন্ন প্রতিবাদী কাব্য প্রকাশিত হতে থাকে “লাঙ্গল ও গণবাণী” পত্রিকায়। তাছাড়াও “কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল” এর অনুবাদ এবং “রেড ফ্ল্যাগ”-এর অবলম্বনে রচিত “রক্তপতাকার গান” তিনি প্রকাশ করেছিলেন তার পত্রিকায়। কবিকে প্রভাবিত করেছিল এক সাথে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন আবার মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে যেমন ইংরেজদের বিনা রক্তপাতে ভারত বিতাড়ণের পক্ষপাতী ছিলেন আবার তুর্কীর কামাল পাশার নেতৃত্বে  আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ এর সমর্থক ছিলেন এবং তিনি তুরস্কের মত ভারত বর্ষকেও ধর্মনিরপেক্ষ দেখতে চেয়েছিলেন। এখানে আরও একটি ব্যাপার উল্লেখ করার মত তা হল- তৎকালীন সময়ে এই দুইটি আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী সংগ্রাম হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। যদিওবা তিনি আবার সশস্ত্র সংগ্রামের কথাও ফেলে দেন নি, বস্তুত তিনি একটি স্বাধীন ভারত বর্ষ চেয়েছিলেন যেটা বিনা রক্তপাতে হলে ভাল, না হলে প্রয়োজনে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে হলেও অর্জন করার পক্ষপাতী ছিলেন।

নজরুল কামাল পাশায় বেশি মজেছিলেন কারণ তিনিও স্বপ্ন দেখতেন তুরস্কের মত ভারতবর্ষও আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ হবে, ধর্মান্ধতা থাকবে না, থাকবে না দমন নিপীড়ন। তিনি ভেবেছিলেন তুরস্ক পারলে ভারতবর্ষে কেন নয়। ১৯২০ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য কংগ্রেসের সমর্থন চেয়েছিলেন কিন্তু না তিনি পান নি এবং নির্বাচনেও তিনি সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। এর কিছুদিন পরেই ১৯২১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে মুজফ্‌ফর আহমদ ও নজরুল তালতলা লেনের যে বাসায় ছিলেন সে বাড়িতেই ভারতের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছিল।তিনি নিজে সদস্য না হলেও সবসময় সমাজতান্ত্রিক দলটির সাথে একাত্মতা পোষণ করতেন, বিভিন্ন সভা সমাবেশে বিপ্লবী সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, ব্যানার করতেন। ১৯২১ সালে সারা ভারতব্যাপী হরতালে নজরুল ছিলেন অগ্নিশর্মা। নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, "ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী"।

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় জগৎবিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতা, যা কবিকে ভারতবর্ষ ছাপিয়ে বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন –

আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!

আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর
চির-উন্নত মম শির!

রাজনীতি সচেতন এবং ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনের একজন মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন কবি ইংরেজদের কাছে। সবসময় তিনি ইংরেজিদের রোষানলে ছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন আনন্দময়ীর আগমনে। কবিতাটির শুরুর পঙক্তিতে ছিল ক্ষোভ আর হতাশা আর ঘৃণার কথা। যেমন লিখেছেন তিনি –

আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী চাঁড়াল।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভু-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?

রাজনৈতিক কবিতা হওয়ার অপরাধে ১৯২২ সালের ৮ ই নভেম্বর ইংরেজরা এটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে এবং একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়।   ১৯২৩ সালে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে জবানবন্দী দেন যা রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে খ্যাত। তিনি বলেছেন –
আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়,সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...

প্রহসনের বিচারে কবির ১ বছরের সাজা হয়, তাকে এই সময়ে সমর্থন জানিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। তিনি তখন রচনা করেছিলেন আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। যেমনটি লিখেছেন – 

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্ললে
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন,
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে-
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে। 

নজরুলের বিদ্রোহী ভাবের সমার্থক অসংখ্য কিন্তু তার সাথে সাথে অনেকে আছেন নজরুলকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলে তার সৃষ্টিকে বিভক্ত করে। অনেকে এখনো কবিকে কাফের মনে করেন, আবার অনেকে কবিকে সাম্প্রদায়িক বলে অভিহিত করেন। নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাসেল ফেল ম্যাকডারমট বলেছিলেন, দুই বাংলা মিলে দুটি নজরুলের চর্চা করা হচ্ছে; বাংলাদেশে ইসলামী নজরুল, আর পশ্চিমবঙ্গে শ্যামা সঙ্গীতের নজরুল ["নাইন্টি ইয়ারস অব রেবেলিয়ন ?' দ্য প্রেজেন্ট লিগাসিস অব 'বিদ্রোহী' ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া"]। এতে নজরুল চর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। ভারত কেন আমাদের দেশেই এমন ধারা প্রচলিত আছে যে নজরুল হিন্দুদের কবি, কারণ তিনি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন, হিন্দু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। আসল কথা হচ্ছে যারা সাম্প্রদায়িক কোণ থেকে বিবেচনা করছেন কবিকে তাদের কাছে তিনি এমনই। তাদের নিজেদের আগে সাম্প্রদায়িক ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আসতে হবে নাহলে নজরুল মূল্যায়ন তাদের না করাই ভালো। আরেকজন গবেষক, ড. পিটার কাস্টারস ["নজরুল ইসলাম'স গ্রেটনেস টুডে"] নজরুলকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সিনথেসিস বা সমন্বয়ের কবি বলে। আদতে দেশে যেখানে ধর্মান্ধ শক্তির রম রমা অবস্থা সেখানে নজরুলের মত অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবিকে সঠিক মূল্যায়ন করা হবে না সেটাই শ্রেয়। কবির বিখ্যাত কবিতা 'উমর ফারুক'-এ এখনকার ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক একটি স্লোগানের 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার' অনুযায়ী একটি প্রসঙ্গ আছে।

"সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি' শত্রু-গির্জা-ঘরে
বলিলে, 'বাহিরে যাইতে হইবে এবার নামাজ তরে!'
কহে পুরোহিত, 'আমাদের এই আঙিনায় গির্জায়,
পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার দরগায়?'
হাসিয়া বলিলে, 'তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ
নামাজ আদায় করি, তবে কাল অন্ধ লোক-সমাজ
ভাবিবে খলিফা করেছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি
আজ হতে যেন এই গির্জারে মোরা মসজিদ করি!"

কাজী নজরুল ইসলামের নীরব হয়ে যাওয়ার দশ বছর পরে ১৯৫২ সালে পরবর্তী কবি-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘কৈশোরকালে আমিও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন, যা থেকে বেরোবার ইচ্ছেটাকেও অন্যায় মনে হতো — যেন রাজদ্রোহের শামিল; আর সত্যেন্দ্রনাথের তন্দ্রাভরা নেশা, তাঁর বেলোয়ারি আওয়াজের জাদু — তাও আমি জেনেছি। আর এই নিয়েই বছরের পর বছর কেটে গেল বাংলা কবিতার; আর অন্য কিছু চাইলো না কেউ, অন্য কিছু সম্ভব বলেও ভাবতে পারলো না — যতদিন না ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশেন উড়িয়ে হৈ-হৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো।’
 
কবি জসিমউদ্দিনের মতে – “নজরুলের দেশাত্মবোধক অধিকাংশই প্রবন্ধ, কবিতাকারে রচিত। এখানে সুন্দর কথা নয় ভালো কথা পদ্যাকারে রচিত”।  

কড্ওয়েলের ভাষায় এগুলিকে ‘high tend language’ বলা যাইতে পারে। কবিতার জন্মকালে সমাজের দলপতিরা যে-সব কথা সকলকে জানাইবার প্রয়োজন মনে করিতেন তাহা এই ‘high tend language’-এ রচিত হইত।

সমসাময়িক প্রাবন্ধিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯২৭ সালেই লিখছেন- “নজরুল ইসলাম বেদনার কবি”। তাঁহার প্রায় সমস্ত রচনাই বেদনার সুরে ভরপুর। আর্ত-ব্যথিত-উৎপীড়িত মানবমনের ব্যথাকেই তাঁহার রচনার মধ্য দিয়া তিনি ফুটাইয়া তুলিতেছেন। বেদনা ব্যক্তিগত মনের অভিব্যক্তি হইলেও ইহার অনুভূতি বিশ্ববাসীর মনেই খেলা করে। সুতরাং বেদনা একটা বিশ্বজনীন অনুভূতি।…কাব্যকার যখন ব্যক্তিগত বেদনার কথা ভুলিয়া বিশ্ববাসীর মনে একটা সহানুভূতির তরঙ্গ তুলিতে পারেন, তাহার রচনার ইন্দ্রজালে যখন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত বেদনার কথা ভুলিয়া সমগ্র বিশ্বমনের বেদনাবোধের সহিত নিজ মনের যোগ সাধন করিতে পারে, তখনি কাব্যকারের রচনা সফল হয় — তখনি তাহার রচনা বিশ্বসাহিত্যে স্থান লাভের যোগ্য হয়। নজরুলের কাব্যে বেদনার এই বিশ্বরূপ আছে বলিয়াই তাঁহার কাব্যকে আমরা বিশ্বসাহিত্য বলিয়া অভিনন্দন করি।

বস্তুত তিনি রবীন্দ্র যুগে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা তাকে কালের পরিক্রমা ছাড়িয়ে মহাকালে নিয়ে গেছে। তিনি কালোত্তীর্ণ, তার লেখা গান, কবিতা, আজো বিশ্ববাসীকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, মুক্তিকামী মানুষের মাথার উপরে তিনি ছাতা হয়ে আছেন।  

বন্ধু কমরেড  মুজাফফর আহমদ  বলেছিলেন- “আমি তাকে যত বড় দেখতে চেয়েছিলেম তার চেয়েও সে অনেক, অনেক বড় হয়েছে“

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল
অনেকে অভিযোগ আনয়ন করেন এই মর্মে যে – রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের বিরোধ ছিল। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বিরোধ তো দুরের কথা বরং রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বেশ সম্মোহন করতেন এবং দুই কবির মাঝে বেশ ভাব ছিল। সেটার প্রতিফলন দেখা যায় যখন ধূমকেতু পত্রিকা বের করেন নজরুল তখন। পত্রিকার শুরুতে কবিগুরুর বাণী থাকতো। যেটি ছিল নজরুলের পত্রিকার প্রতি আশীর্বাদ স্বরূপ। বস্তুত ধূমকেতু তখনকার চাওয়া পাওয়া কে ধারণ করেই প্রকাশিত হত। কবিগুরু লিখেছেন ধূমকেতুর জন্য –

কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।

তাছাড়া আনন্দময়ীর আগমনে কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পরে নজরুল কে আটক করে ১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলে কবিগুরু নজরুল কে বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল খুবই উৎফুল্ল হয়েছিলেন এবং রচনা করেন আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। বস্তুত কবিগুরুর সাথে নজরুলের সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার, রবীন্দ্রনাথ কে পাঠানো নজরুলের তীর্থ পথিক কাব্যে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় এটা  -

তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, বিস্ময়ের বিস্ময়
তব গুন গানে ভাষা সুর যেন সব হয়ে যায় লয়
তুমি স্মরিয়াছ ভক্তের তব, এই গৌরবখানি
রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দ মুক বানী।
কাব্য লোকের বাণী বিতানের আমি কেও নহি আর
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস হার
প্রার্থনা মোর যদি আবার জন্মি এ ধরণীতে
আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে।

কারাগারে কবির অনশন ভাঙ্গানোর  জন্য রবীন্দ্রনাথ নজরুল কে লিখেছেন – “Give us hunger strike, our literature claims you”

পত্রের উত্তরে নজরুল  লিখেছেন- আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বললে তাকে হত্যা করার ই শামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যুও ঘটে তাহলে ও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।

তাছাড়া নজরুলের কৈশোর রবি ও অশ্রু পুষ্পাঞ্জলি কবিতা দুইটি কবিগুরুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখা। গোরা ছবিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত আপত্তি তুললে নজরুল কবিগুরুর কাছে গিয়েছিলেন, কবিগুরু তাকে বললেন আমার গান তোমার চাইতে কি ওরা ভাল বুঝবে ... রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাবহ ভারতবর্ষকে সান্ত্বনা দিতে তিনি রচনা করেছেন –

“ঘুমাইতে দাও, শান্ত রবিরে জাগায়োনা।
সারা জীবন যে আলো দিল ঢেকে তার ঘুম ভাঙ্গায়োনা।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল ইসলামের আন্তরিক সম্পর্ক অটুট থাকুক এটা মৌলবাদী মুসলমানরা যেমন চাননি, তেমনি চাননি মৌলবাদী হিন্দুরাও। দু’জনের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাবার জন্য দু’পক্ষ থেকেই নানা ধরনের সমালোচনা, আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র অবিরামভাবে চলে আসছিল। ধর্ম যাদের কাছে মুখ্য তাঁরা যে সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করার যোগ্যতা বা অধিকার রাখেন না, তা রবীন্দ্রনাথ যেমন জানতেন, তেমনই জানতেন নজরুলও। তাই তাঁরা মানবিকতার সাধনাই করে গেছেন চিরকাল।

মানবতার এ মহান দূতকে বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালের ২৪শে মে ভারত সরকার থেকে অনুমতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭৪ সালে কবিকে বাংলা সাহিত্যে অপরিসীম অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে কবিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় এবং ২১শে পদকে ভূষিত করা হয়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে কবি আক্রান্ত ছিলেন অনেকদিন, দেশ বিদেশের বহু জায়গায় চিকিৎসা করেও কবিকে সুস্থ করা সম্ভব হয় নি, জীবনের অনেক দশক তিনি নির্বাক ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট বাংলা সাহিত্যকে ঋণী করে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আজীবন বিপ্লবী নজরুল সবসময় মানুষের জয়গান গেয়েছেন , তিনি লিখেছেন-

“হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন, কাণ্ডারি বল দুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মোর”

অন্য এক কবিতায় তিনি লিখেছেন –

পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।

মানবতার এই মহান দূতের জীবনী হোক আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি। যুগ যুগ ধরে আলো ছড়াক আমাদের মননে। আমাদের আত্মার খোরাকে দুখু মিয়া জাগরূক থাকুক হাজার লক্ষ কোটি বছর ধরে।
 
দোহাই –
১.উইকিপিডিয়া  
২.গুগল   
৩.অসাম্প্রদায়িক নজরুল- মোহিত উল আলম
৪.নজরুলের কবিতা  ভাবনা-বেদনা, আবদুল মান্নান সৈয়দ
৫.নজরুল রচনাবলী -৮ সহ নজরুলের অসংখ্য কবিতার বই।
৬.দৈনিক সমকাল  
৭. শব্দ-ধানুকী নজরুল ইসলাম, সাহাবুদ্দিন আহমদ।
৯. দৈনিক জনকণ্ঠ।

আপনার মন্তব্য