বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ৬-৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৬-০৯ ১৩:৪১:৪৪

কাজী মাহবুব হাসান:


তেরেজা ভেতরে ফিরে যায় কাপড় পরার জন্য, বড় একটি আয়নার সামনে এসে দাড়ায়।

না, তার শরীরে কোনো কিছুই দানবীয় আকারের নয়। কাঁধ থেকে থলের মত স্তন ঝুলে নেই তার, আসলেই, তার স্তনগুলো আকারে বেশ ছোটো। তার মা তাকে ঠাট্টা করতো এত ছোটো স্তনের জন্য। এবং এটা নিয়ে সবসময়ই সে একটা মানসিক চাপের মধ্যে ছিল, যতদিন না তার সাথে টমাসের দেখা হয়েছে।কিন্তু স্তনের আকার নিয়ে নিজের সাথে তারা বোঝাপড়ার নিষ্পত্তি হলেও, এখনও সে বেশ লজ্জা পায় স্তনের বোঁটার চারপাশে ঘিরে থাকা অনেক বড় আর খুব কালো গোলাকার বৃত্তটির জন্য। যদি সে তার নিজের শরীর পরিকল্পনা করতে পারতো, তাহলে সে চোখে না পড়ার মতই স্তনের বোঁটা বেঁছে নিত, সেই ধরনে যা স্তনের চুড়া থেকে সামান্য একটু বের হয়ে থাকে, চামড়ার বাকী অংশের রঙের সাথে যা প্রায় মিশে যায়। তার স্তনবৃন্তের চারপাশে কালো বৃত্তাকার অংশটিকে সে ভাবতো বড় লাল লক্ষ্যবস্তু নির্দেশকারী কোনো চিহ্ন দরিদ্রদের জন্য যৌনউত্তেজনক ছবি হিসাবে যা এঁকেছে কোনো আদিম শিল্পী।

নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে, সে ভাবছিল, তাকে দেখতে কেমন লাগতে পারে, যদি তার নাক প্রতিদিন এক মিলিমিটার করে বাড়তে থাকে।কত দিন লাগতে পারে তার চেহারা অন্য কারোর মত দেখতে শুরু হবার জন্য?

এবং যদি শরীরের  নানা অংশ বাড়তে বা কমতে শুরু করে, তেরেজা আর তার মত দেখতে থাকবে না, তারপরও কি সেই একই মানুষ থাকবে? সেকি তখনও তেরেজাই থাকবে?

অবশ্যই, এমনকি যখন তেরেজা পুরোপুরিভাবে তেরেজার মত নয়, তার ভিতরে বাস করা আত্মা একই থাকবে, এবং সে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে তার শরীরে ঘটতে থাকা বাহ্যিক সেই পরিবর্তনগুলোর দিকে।

তাহলে তেরেজার সাথে তার শরীরের সম্পর্কটা আসলে কেমন?  তার শরীর কি তাকে তেরেজা বলে ডাকার অধিকার রাখে? যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে নামটি আসলে কি তথ্য নির্দেশ করছে? শুধুমাত্র  এমন কোনো কিছু যা অশরীরী, অস্পৃশ্য?

(এই প্রশ্নগুলো তেরেজার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার শৈশব থেকেই। আসলেই, একমাত্র গভীর প্রশ্নগুলোর হচ্ছে সেই প্রশ্নগুলো, যা কিনা একটি শিশুও সূত্রবন্ধ করতে পারে। শুধুমাত্র সবচেয়ে সরলতম প্রশ্নগুলোই সত্যিকারভাবে গভীর। এগুলো হচ্ছে সেই প্রশ্নগুলো যাদের কোনো উত্তর নেই। উত্তরহীন কোনো প্রশ্ন হচ্ছে সেই দেয়ালের মত যা ভাঙ্গা যায় না। অন্যার্থে, উত্তরহীন এই প্রশ্নগুলোই মানব সম্ভাবনাগুলোয় সীমানা নির্ধারণ করে, মানব অস্তিত্বের সীমানা নির্দেশ করে)।

তেরেজা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকে, তার শরীরের দিকে সে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন সেটি তার অচেনা কেউ, অথচ তার সাথেই সংশ্লিষ্ট, অন্য কারো সাথে নয়। তার শরীরটার প্রতি সে ঘৃণা অনুভব করে। টমাসের জীবনে একটি মাত্র শরীর হবার ক্ষমতা এর নেই। এটি তাকে হতাশ আর প্রতারিত করেছে। সারারাত ধরেই টমাসের চুল থেকে তাকে অন্য নারীর যোনীর গন্ধ ভরা শ্বাস নিতে হয়!

হঠাৎ করেই তার শরীরটাকে বাতিল করার তীব্র একটি ইচ্ছা সে অনুভব করে যেমন করে কেউ কোনো চাকরকে বরখাস্ত করে: টমাসের সাথে শুধু আত্মা হিসাবে থাকার জন্য এবং শরীরটাকে তার বাইরের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য, অন্য নারী শরীরগুলো যেভাবে পুরুষ শরীরগুলোর সাথে আচরণ করে সেভাবে আচরণ করার জন্য।যদি তার শরীর টমাসের জন্য একমাত্র শরীর না হতে পারে, এবং এভাবে জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধে সে যদি পরাজিত হয়, তাহলে এই শরীরের একা একাই পরিত্যাগ করা যেতে পারে!


তেরেজা বাসায় ফিরে আসে, জোর করে রান্নাঘরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করে।সাড়ে তিনটার পর, সে কারেনিনকে তার গলায় বন্ধনী পরিয়ে নিয়ে হাটতে বের হয় (আবারো হাটা) শহরের শেষ প্রান্তের দিকে, যেখানে তার বর্তমান কর্মস্থল, হোটেলটি অবস্থিত। যখন তারা পত্রিকা থেকে তেরেজাকে বরখাস্ত করেছিল, একটা হোটেলের বারে কাজ পেয়েছিল সে, এটি ঘটেছিল জুরিখ থেকে ফিরে আসার বেশ কয়েক মাস পর: পরিশেষে তারা তাকে ক্ষমা করতে পারেনি, রুশ ট্যাঙ্কগুলোর ছবি তুলে কাটানো সেই সপ্তাহটি জন্য। বন্ধুদের মাধ্যমেই কাজটি সে যোগাড় করেছিল, অন্যরা যারা সেখানে আশ্রয় পেয়েছিল, যখন রুশরা তাদের কাজ থেকে বের করে দিয়েছিল: ধর্মতত্ত্বের একজন প্রাক্তন অধ্যাপক অ্যাকাউন্টিং অফিসে, একজন রাষ্ট্রদূত ( যিনি রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করেছিলেন বিদেশী টিভিতে) অভ্যর্থনা ডেস্কে।

তার পা গুলো নিয়ে বেশ সে চিন্তিত ছিল। ছোট শহরের রেস্টুরেন্টে ওইট্রেস হয়ে কাজ করার সময় বয়স্ক ওয়েইট্রসদের ভ্যারিকোস ভেইন বা ফুলে যাওয়া শিরা দেখে  সে ভীষণ ভয় পেয়েছিল। পেশাগত ঝুঁকি, যা আসে ভারী কিছু বহন করে দীর্ঘদিন হাটা দৌড় কিংবা দাড়িয়ে থাকার কারণে।কিন্তু তার নতুন কাজে এত চাপ নেই, যদিও প্রতিদিন তার শিফট শুরু হয় বিয়ার আর পানির বোতলের ভারী ক্রেট ঠেলে বের করে আনার মাধ্যমে, তাকে শুধু বারের পিছনে দাড়িয়ে থাকতে হয়, খদ্দেরদের বিয়ার পরিবেশন করা আর তার কাছেই ছোট একটা বেসিনে গ্লাসগুলো ধোয়ার জন্য। এবং পুরো সময়টায় আনন্দের সাথে তার পায়ের কাছে বসে থাকে কারেনিন।

মধ্যরাতের পর তার অনেকটুকু সময় পেরিয়ে যায় হিসাব শেষ করে হোটেল পরিচালকের হাতে রশিদসহ নগদ টাকা বুঝিয়ে দিতে দিতে। এরপর প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতকে বিদায় জানাতে যায় তেরেজা, রাতে যার কাজ শুরু হয়। অভ্যর্থনা ডেস্কের পিছনে দরজা দিয়ে ঢোকা যায় সংকীর্ণ একটি বিছানা পাতা তার ছোট একটি কক্ষে তিনি থাকেন, যেখানে কাজে ফাকে মাঝে মাঝে তিনি একটু ঘুমিয়ে নিতে পারেন।বিছানার উপরের ফ্রেমে বাধানো নানা ছবি দিয়ে দেয়ালটি ভরা, তার এবং কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিদের, যারা কেউ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, তার হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছেন কিংবা তিনি কোনো টেবিলে বসে আছেন, যখন তার পাশে কেউ কিছু স্বাক্ষর করছেন। কোনো কোনোটায় ছবির উপর স্বাক্ষরও আছে। সবচেয়ে সম্মানিত হিসাবে চিহ্নিত জায়গাটিকে একটি ছবি, যেখানে  তিনি ও জন. এফ. কেনেডি হাসিমুখে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছেন।

সেই রাতে তেরেজা যখন তার রুমে প্রবেশ করেছিল, তখন তিনি কেনেডির সাথে কথা বলছিলেন না, বরং ষাট বছরের কাছাকাছি বয়সী এক ব্যক্তির সাথে কথা বলছিলেন, যাকে তেরেজা এর আগে কখনও দেখেনি, যিনি তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সাথে সাথেই চুপ করে যান।

‘কোনো অসুবিধা নেই, ঠিক আছে’, রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘ও আমাদের বন্ধু, ওর সামনে তুমি নির্ভয়ে কথা বলতে পারো’। এরপর তিনি তেরেজার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ উনার ছেলের আজ পাঁচ বছরের জন্য সাজা হয়েছে’।

পরে সে জানতে পেরেছিল, রুশ আগ্রাসনের প্রথম দিনগুলোয় লোকটির ছেলে আর কিছু বন্ধু একটা ভবনের দরজায় নজর রেখেছিল, সেই ভবনটি ছিল রুশ আর্মি স্পেশাল স্টাফদের। এই ভবনের ভিতরে ঢুকতে ও বের হওয়া চেক নাগরিকদের তারা দেখেছিল, তারা স্পষ্টতই ছিল রুশদের দালাল, এবং সে ও তার বন্ধুরা তাদের অনুসরণ করেছিল, তাদের গাড়ির নাম্বার প্লেট খুঁজে তাদের ঠিকানা বের করেছিল এবং সেই তথ্যগুলো তারা পাচার করেছিল দুবচেক সমর্থক গোপন রেডিও ও টেলিভিশন সম্প্রচারকদের কাছে। যারা এরপর এদের সম্বন্ধে জনগণকে সতর্ক করে দিত।এই প্রক্রিয়ায় ছেলেটি ও তার বন্ধুরা একজন বিশ্বাসঘাতককে বেশ মারধোরও করেছিল।

ছেলেটির বাবা বলেছিলেন, তাদের অপরাধের একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে এই ছবি, সে পুরোটাই অস্বীকার করেছিল যতক্ষণ না তারা ছবিটি তাকে দেখায়।

ওয়ালেট থেকে কাগজের একটি টুকরোটা সে বের করে, ১৯৬৮ সালে হেমন্তে টাইমস পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল।

একজন তরুণ এক ব্যক্তিকে গলা চেপে ধরে আছে এবং পেছনে বেশ কিছু মানুষের ভিড় যারা দৃশ্যটি দেখছে।দালালকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে এমনই ছিল ছবিটার শিরোনাম।

তেরেজার দম ছাড়তে পারলো, না, এটা তার তোলা কোনো ছবি না।

রাতের প্রাহায় কারেনিনকে নিয়ে বাড়ী ফেরার সময়, সেই দিনগুলোর কথা সে ভাবছিল, যখন সে ট্যাঙ্কের ছবি তুলেছিল, কত অবোধ আর বিশ্বাসপ্রবণ ছিল তারা, ভেবেছিল তারা তাদের দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে অথচ তারা রুশ পুলিশকেই সাহায্য করেছিল।

রাত দেড়টার পর বাসায় ফেরে তেরেজা। টমাস তখন ঘুমিয়ে, তার চুল থেকে ভেসে আসছে কোনো নারীর যোনীর গন্ধ।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য