ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা-৪

রেজা ঘটক

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-০৮ ০৪:১০:০৬

 আপডেট: ২০১৫-০৮-০৮ ০৪:১৫:০৮

প্রচ্ছদ: মোবাশ্বির আলম মজুমদার

বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:

১০ মে ১৯৯২ অটাবে, ব্রাটুনাচ

পাহাড়ি জঙ্গল ঘেরা যে গ্রামে আমরা গত এক সপ্তাহ ধরে পালিয়ে আছি, স্থানীয়দের কাছে শুনলাম, এই গ্রামের নাম অটাভে। ইংরেজিতে যার বানান হল- ও, টি, এ, ভি অ্যান্ড ই। অটাভে বা OTAVE । অটাভে নামে সুইজারল্যান্ডেও একটা সুন্দর গ্রাম আছে। সেই একই নামে বসনিয়ায়ও যে একটা গ্রাম আছে আমার একদম জানা ছিল না। 

এই পাহাড়ি জঙ্গলে আমাদের মতো যারা রিফিউজি তাদের কাছে খবর পেলাম যে, সবাই আজ ব্রাটুনাচ যাবে। ব্রাটুনাচ থেকে সকল রিফিউজিদের রেডক্রসের গাড়ি নিতে আসবে। রেডক্রসের গাড়ি ব্রাটুনাচ থেকে আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আমরা কেউ জানি না। কেউ বলছে, সবাইকে তুজলার দিকে নিয়ে যাবে। কেউ বলছে, সবাইকে জিভিনিচ্ছে নিয়ে যাবে। ছোট খালা মার্সিয়া বললো, সবাই যেখানে যাবে, আমাদেরও সেখানে যাওয়া উচিত। মরলে সবাই একসাথে মরব।

অটাভে গ্রামের এই পাহাড়ি জঙ্গলে কোনো খাবার নেই। পানি নেই। আলো নেই। চার বছরের আহমেদের দিকে একদম তাকানো যায় না। গত তিন দিন ধরে আমরা সবাই প্রায় অভুক্ত। একটু রুটি পেলে তা সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েছি। আজ খাবার মতো পানিও নেই। খাবার ছাড়া, পানি ছাড়া আমরা এই জঙ্গলে আর কতো দিন বেঁচে থাকতে পারব কেউ জানে না।

দুপুরের ঠিক আগে আগে অন্যান্য রিফিউজিদের সঙ্গে আমরাও পায়ে হেঁটে অটাভে থেকে ব্রাটুনাচ রওয়ানা হলাম। একে তো পাহাড়ি জঙ্গলা পথ, তার উপর সবাই প্রায় অভুক্ত। পা যেনো আর চলতে চায় না। শরীর টেনে টেনে আমরা পাহাড়ি উঁচু নিচু সেই পথ ধরে কোন মতে অগ্রসর হচ্ছি। এমনিতে অটাবে থেকে ব্রাটুনাচ দেড় ঘণ্টার হাঁটা পথ। কিন্তু ব্রাটুনাচে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগলো।

ব্রাটুনাচ হল বসনিয়ার একেবারে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ছোট্ট একটি মিউনিসিপল টাউন। পাহাড়ি উপত্যকায় এই মিউনিসিপল শহরটি গড়ে উঠেছে। শহরের পাশ দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে বয়ে গেছে দ্রিনা নদী। প্রচুর গাছপালায় চারদিক সবুজ আর সবুজ। দ্রিনা নদীর ঠিক ওপারে সার্বিয়া। দ্রিনা নদী এখানে সার্বিয়ার সঙ্গে বসনিয়ার সীমানা। সমতল অংশে দ্রিনা নদী সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭৫ মিটার উঁচু। আর পাহাড়ি অংশে দ্রিনা নদী প্রায় ৪০০ থেকে ৮০০ মিটার উঁচু।

মোট মিউনিসিপল টাউনের মাত্র ৩০ ভাগ সমতল ভূমিতে আর বাকী প্রায় ৭০ ভাগ পাহাড়ি ভূমিতে অবস্থিত। গ্রীষ্মকালে এখানে যেমন খুব গরম, তেমনি শীতকালে এখানে ভারী তুষারপাত হয়। আর বর্ষাকালে এখানে খুব বৃষ্টি হয়। এখানে গড়ে বছরে প্রায় ১০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এখন এপ্রিল মাস। তাই দিনে এখানে প্রচন্ড গরম, আর রাতে একটু একটু শীত পড়ে।

ছয়শ’ বছর আগে ১৩৮১ সালে ব্রাটুনাচ ভায়া হয়ে বসনিয়া থেকে সার্বিয়া যাওয়ার একটা রাস্তা নির্মিত হয়েছিল। তখন এখানে মাত্র পাঁচটি পরিবার প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল। তখন ব্রাটুনাচের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ জন। ১৯২৭ সালে ব্রাটুনাচ মিউনিসিপল টাউনে পরিণত হয়। ১৯৪৮ সালের দিকে এখানে জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ হাজারে।

মূল ব্রাটুনাচের জনসংখ্যা এখন প্রায় পনেরো হাজার। যার মধ্যে প্রায় ৬৫ ভাগ বসনিয়াক মুসলিম, প্রায় ৩৩ ভাগ অর্থোডক্স সার্ব, প্রায় ১ ভাগ ক্যাথলিক ক্রোয়াট আর ১ ভাগ অন্যান্য যুগোশ্লাভ জনগোষ্ঠী। কিন্তু এখন বসনিয়ায় যুদ্ধের কারণে গোটা পাহাড়ি উপত্যকায় আমাদের মতো অসংখ্য রিফিউজি আশ্রয় নেয়ায়, এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। যাদের বেশিরভাগই বসনিয়াক মুসলিম। এতো অধিক সংখ্যক মানুষের এই পাহাড়ি জনপদে একসঙ্গে হয়তো এবারই প্রথম পদচারণা।

ব্রাটুনাচে পৌঁছার পর আমরা কিছু খাবার পেলাম। পানির বোতলও পেলাম। রেডক্রস আমাদের এই খাবার আর পানি সরবরাহ করেছে। আমরা সেই খাবার আর পানি পেয়ে যেনো জীবন ফিরে পেলাম। রেডক্রসের বড় বড় বাস সারি সারি করে দাঁড়িয়ে আছে। দলে দলে রিফিউজিরা সেই বাসে ছুটে গিয়ে গাদাগাদি করে বসছে।

আহমেদের খাওয়া শেষ হলেই ছোট খালা, আহমেদ আর আমিও একটা বাসে গিয়ে অন্যান্য রিফিউজিদের সঙ্গে বসলাম। বাস কোথায় যাবে আমরা কেউ জানি না। এই বাসগুলো আমাদের জীবনের সন্ধানে নিয়ে যাবে নাকি মরণের জন্য নিয়ে যাবে, আমরা তার কিচ্ছুই জানি না। তবু জীবনের আশা নিয়ে আমরা রেডক্রসের সেই বাসের মধ্যে উঠে গাদাগাদি করে বসলাম।

আমাদের মতো অন্যান্য রিফিউজিদের চোখেমুখেও ভারী আতংকের ছাপ। জীবন আর মরণের মাঝখানে এক রহস্যময় নো-ম্যানসল্যান্ডে আমরা রেডক্রসের সেই বাসে বসে অনিশ্চিত এক যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমাদের যাত্রা কি জীবনের দিকে নাকি মরণ আমাদের জন্য ওৎ পেতে আছে আমরা তার কিছুই জানি না। তবু আমরা সেই আকাশি রঙের বাসের মধ্যে বসে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকলাম।

আকাশের রঙ এখন গাঢ় বাদামী। এটা কি আসন্ন বিপদের চিহ্ন! গাঢ় বাদামী আকাশের ফাঁক গলিয়ে একটু একটু নীল আকাশও দেখা যাচ্ছিল। ওটা কি বেঁচে থাকার কোনো রহস্যময় আলামত? অনলি গড নোজ!

মা, ডেভিড, নানা, নানী ওরা কোথায় আছে কিছুই জানি না। ওরা বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। বেঁচে থাকলে কোথায় আছে তাও জানি না। কিভাবে কোথায় বেঁচে আছে তাও জানি না। জীবনে আর কখনো ওদের সাথে দেখা হবে কিনা তাও জানি না। বারবার ঘুরে ফিরে মা, ডেভিড, নানা, নানী ওদের মুখগুলো মনে পড়ছে। মাত্র ষোল বছরে ওদের সঙ্গে আমার কতো কতো স্মৃতি। হাজারো সেই সব স্মৃতি বারবার মনে পড়ছে। মানুষের কি মৃত্যুর আগে আগে এভাবে জীবনের সকল স্মৃতিই একসঙ্গে মনে পড়ে? তাহলে কি আমরা মৃত্যুর দিকেই যাচ্ছি? রেডক্রসের বাস আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? মৃত্যুর দিকেই ?

সার্ব সেনাবাহিনী যদি পথে আমদের বাসে হামলা করে? তখন কি হবে? তখন আমরা কি আর বেঁচে থাকতে পারব? সার্ব সেনাবাহিনী যদি ছোট খালা আর আমাকে রেপ করে? যদি তারা আহমেদকে গুলি করে হত্যা করে? না, এসব ভাবতে আর ভালো লাগছে না। মাথা ঝিম ঝিম করছে। মনে হচ্ছে এখনই বমি আসবে। কিন্তু বমি আসল না। মাথার কোষে কোষে অসংখ্য দুঃশ্চিন্তা একসঙ্গে আছড়ে পড়ছে। চোখ খুলে রাখতে ভারী কষ্ট হচ্ছে। ছোট খালার ঘাড়ে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকলাম।

মুহূর্তে মায়ের হাসিমুখখানা ভেসে উঠল। হাসলে মাকে খুব সুন্দর দেখায়। ডেভিড আর আমি যখন ঝগড়া করি, তখনো মায়ের মুখে থাকতো সেই হাসি। ছোটবেলায় কখনো মা আমাদের ঝগড়ার সময়ও ধমক দেয়নি। মা কখনো ধমক দিলেও তা দিয়েছে বড় হবার পর। স্কুল থেকে দেরি করে বাসায় ফিরলে। বান্ধবী’র বাসায় বেশি রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলে। আর টেলিফোনে বেশি কথা বললেও মা ধমক দিতেন। আর যদি অভিমান করে খাবার না খেতাম, তখনো মা ধমক দিতেন। কিন্তু অল্প পরেই মা আবার তার হাসি মুখ নিয়ে আদর করে সবই পুষিয়ে দিতেন। তাই মায়ের উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারতাম না।

বারবার কেন আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে? মা কি বেঁচে আছে? ডেভিড, নানা, নানী ওরা সবাই কি বেঁচে আছে? কোথায় আছে ওরা? ছোটখালু আমাদের ওটাবে’র জঙ্গলে রেখে যাবার পর ওদের খোঁজে জোয়ার্নিক গেলেন। জোয়ার্নিকে কি ছোটখালু পৌঁছাতে পেরেছিলেন? ওদের কি ছোটখালু খুঁজে পেয়েছেন? ছোটখালু কি বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন ছোটখালু?

রেডক্রসের এই বাস থেকে পথে যদি আমাদের ওরা কিছু করে? যদি সার্ব সেনাবাহিনী আমাদের ধরে নিয়ে যায়? ছোটখালু’র সাথে কি আর আমাদের দেখা হবে না? এসব ভাবনার মধ্যেই বিকাল চারটার দিকে রেডক্রসের বাসগুলো একটি একটি করে অজানা অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটলো।

সারি সারি আকাশি বাস। বাস ভর্তি সবাই রিফিউজি, বসনিয়ান মুসলিম। নারী, শিশু আর বয়স্ক মানুষে রেডক্রসের বাসগুলো ঠাসা। বাসগুলোর সামনে পেছনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর গাড়ি। জাতিসংঘের সেনাদের হাতেও ভারী অস্ত্র-শস্ত্র। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, একে ৪৭, মেশিনগান। আরো কতো কতো ভয়ানক সব অস্ত্র-শস্ত্র ওদের হাতে। ওদের গাড়িতে আবার কামানও আছে। কামানের মুখ সামনে পেছনে তাক করা। মেশিনগানের নলগুলো একটু পরপর দিক পরিবর্তন করছে। রাডারের মতো ঘুরছে মেশিনগানের তাক করা সেই নলগুলো। নাকি কেউ বসে বসে ওটা ঘুরাচ্ছে?

পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদ এসে আমাদের মুখে পড়ছে। ছোটখালা আঁচল দিয়ে কোলে বসা আহমেদের মুখ ঢেকে দিলেন। আহমেদের ছোট্ট হাত দুটো আমার মুঠোয় বন্দি। ছোট্ট হাতের সেই ছোট ছোট আঙুলগুলো আমার হাতের মুঠোয় খেলা করছিল। ছোটখালার আঁচলে মুখ ঢাকা থাকলেও খাবার খাওয়ার পর থেকে আহমেদ একটু সতেজ। সেই সতেজতার আনন্দে ছোট্ট আঙুলগুলো একটু পর পর থেমে থেমে দুষ্টোমি করছিল। হয়তো একটু পরেই আমরা কোনো নতুন জীবনের সাথে পরিচয় হব। তখন আরো বেশি আনন্দ করা যাবে। কিন্তু আধঘণ্টা না চলতেই হঠাৎ রাস্তার মোড়ে রেডক্রসের বাসগুলোর সারি দাঁড়িয়ে পড়ল।

বাসগুলো যখন দাঁড়াল তখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী সেনাদের গাড়িগুলো হঠাৎ রহস্যময় কারণে অদৃশ্য হয়ে গেল। গোটা বাসে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল সার্ব সেনাবাহিনী বাস থামিয়েছে। সেই গুঞ্জনে নারীদের মধ্যে অনেকেই খামাখা কান্না জুড়ে দিল। সেই কান্নায় তাদের সঙ্গে থাকা ছোট ছোট শিশুরাও কান্না জুড়ে দিল। গোটা বাসের মধ্যে সেই কান্নার ভয়ানক শব্দে সবার হার্ট ফেল করার দশা। রেডক্রসের সবগুলো বাস সারি সারি দাঁড়িয়ে থেমে আছে। এতোক্ষণ আমরা ব্রাটুনাচ থেকে ছোট রাস্তা ধরে আসছিলাম। মহাসড়কে ওঠার পরপরই এই অবস্থা।

সামনে সার্ব সেনাবাহিনী প্রত্যেকটা বাস তল্লাশি করছে। বাস ভর্তি রিফিউজিদের আগে নামাচ্ছে। রিফিউজিদের মধ্যে যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত পুরুষদের আর একটু উঠতি বয়েসি ছেলেদের আলাদা করছে সার্ব সেনাবাহিনী। আর নারীদের মধ্যে যাকে পছন্দ হচ্ছে তাদের ভিন্ন একটা লাইনে দাঁড় করাচ্ছে। সার্ব সেনাবাহিনীর দৃষ্টিতে যাদের তারা ছেড়ে দেবে বলে মনে করছে, তাদের আবার বাসে ওঠার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে। এভাবে প্রত্যেকটি বাসে সার্ব সেনাবাহিনী তল্লাশি করছে। নারী পুরুষ আলাদা করছে।

আমাদের ঠিক আগের বাসের তখন তল্লাশি কার্যক্রম চলছে। সেই বাসের এক পুরুষ রিফিউজিকে তার বউ কিছুতেই ছাড়ছে না। জোর করেই সেই মহিলাকে তার স্বামী থেকে আলাদা করা হল। পুরুষ লোকটি তার স্ত্রীকে কিছু একটা বলার জন্য লাইন থেকে আবার স্ত্রীর দিকে গেলেন, কিছু একটা বললেন। তারপর আবার সেই আগের আলাদা লাইনে দাঁড়াচ্ছিলেন, ঠিক তখনই একজন সার্ব সেনা তাকে একটু সামনে ডাকলো। লোকটি কয়েক পা সামনে আসতেই সেই সার্ব সেনা তাকে ব্রাশফায়ার করলো। মুহূর্তে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা গেলেন। ভয়ে সবার কান্নাকাটি বন্ধ হয়ে গেল।

আগের পর্বগুলোর লিংক:

বসনা-১ || বসনা-২ || বসনা- ৩

আপনার মন্তব্য