প্রকাশিত: ২০১৮-১১-১৪ ১৩:২৬:২৪
আফরিন জাহান হাসি:
লাল সবুজ রঙ করা চিকন বেতের ঢাকনাটা, কী সুন্দর পানিগুলো ছেকে মাছগুলোকে ধরে রাখে! এগুলো ডাইনিং টেবিলে ভাত তরকারী ঢেকে রাখার ঢাকনা। তার মাঝে যে দুই একটা একটু নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলোই আম্মা দিয়ে দিয়েছে মাছ ধরতে। সকাল শেষের কড়া আলোয় ঝিলের কিনারে পোনাগুলো সব ঝিলমিল করে! বাড়ির পেছনের ঢালে ঝিল পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে মাছ ধরতে অদ্ভুত রোমাঞ্চ জাগে! কিনারের পানিতে ধীরে ধীরে ঢাকনাটা ডুবিয়ে দিয়ে চট করে তুলে ফেলতে হয়, এক দুইটা ছোট চিংড়ি থাকেই। কিন্তু পুরো কাজটাই খুব শান্ত ভাবে করতে হয়, দুটো কারণে, এক বেশি শব্দ করলে মাছগুলো সব কোথায় হারিয়ে যায়, দুই আম্মা জানতে পারলেই ডেকে ঘরে নিয়ে আসে। আমি সবার ছোট, তাই সব কিছুতেই পারবো না, বুঝবো না, জানি না এগুলোই সারাক্ষণ শুনতে হয়। অথচ এই ঝিলের ধারে কেমন যে এক ভালোলাগা রূপকথার গল্পের মত লাগে, আর যে আমার কিছু করারও নেই!
সুস্মিতা! সুস্মিতা!
আসছি আম্মা।
আবার তুই পানির কাছে গেছিস !না মেয়েটা পানিতে ডুবেই মরবে! এই সময় একা একা পানিতে পড়ে থাকলে কেউ তো জানতেও পারবে না। আমি কাজকর্ম বাদ দিয়ে তোকে পাহারা দিবো? উঠে আয়, তাড়াতাড়ি।
আমিতো পানিতে নামি না আম্মা। কিনার ধরে হাঁটি।
ভালো হবে না কিন্তু, আমার কথা বলার সময় নাই, উঠে আয়।
মনটাই খারাপ হয়ে গেল, আম্মাটা যে কি! কত সাবধানে আমি মাছ ধরছিলাম। এসে ভাইটার সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করি, চলনা চিংড়ি ধরি। ও রাজি হয়ে যায়, চল, গামছা দিয়ে ভালো ভাবে ধরা যায়। দুই ভাইই চলল আমার সাথে, ছুটির দিন, সবারই পড়ালেখার চাপ কম। কিন্তু ওরা দুজন একটু পানিতে নেমে গামছা দিয়ে মাছ ধরা শুরু করলো, আর আমি সেই কিনারে কিনারে হাঁটি। হঠাৎই দেখি বড় ভাই বোনেরা সব হই হই করতে করতে পাশের বাসায় যাচ্ছে, ওরা সাতার প্রতিযোগিতা করবে। আমি দৌড়ে যাই দেখতে।
এই ঝিলটা বেশ আঁকাবাঁকা, আমাদের আর পাশের বাসাটার পরেই বেঁকে একটা এল অক্ষরের মত বয়ে গেছে। আমাদের দিকটাতে ঢাল বয়ে বেশ পানির কাছে চলে যাওয়া যায়, আর ‘এল’ এর অন্যপাশে দেয়াল দিয়ে মাটি আটকে রাখা, দেয়ালের পরে খাড়া অংশের অনেক নিচে পানি দেখা যায়। অনেক মোটা করে দেয়া দেয়াল আর এ পাশের মাটির প্রায় কাছাকাছি, অনেকেই সেই দেয়ালে বসে গল্প করে। আমি মাঝে মাঝে বসি, ভয়ে ভয়ে একটু দাঁড়াতেও চেষ্টা করি, নিচে তাকালে গা কাঁপে। এতগুলো ছেলেমেয়ে সাতার কাটছে, কেউ মাত্র শেখার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ আবার দেয়াল থেকে নিচে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ছে। আমি অবাক হয়ে দেখি।
মাছ ধরা ছেড়ে এক ভাই সাতারে যোগ দেয়, অন্যটা তখন আমাকে ডাকে গামছা ধরতে। ও আবার পানিতেও নামতে বলে, আমি ভয়ে ভয়ে একটু নামি। বাহ, কত চিংড়ি! এ সময়েই আম্মার আগমন!
সুস্মিতা, কত বলেছি পানিতে নামবি না, এই পচা পানিতে তোর পায়ের অসুখগুলো আরও বাড়বে! আর এত চিংড়ি ধরে তোর কী লাভ, তুই কি খেতে পারবি? আয় পা ধুয়ে যা।
আম্মার মুখটা হঠাৎ করুণ দেখায়। আমার একটা অসুখ আছে, তার জন্য হোমিওপ্যাথি খাচ্ছি, চিংড়ি খাওয়া ডাক্তারের নিষেধ। অথচ আম্মা এত চমৎকার লাল লাল করে চিংড়ি ভুনা করে যে জিভে জল চলে আসে। আমি আম্মার পাশে পাশে ঘুরি আর ঘ্যান ঘ্যান করি, “আম্মা শুধু একটা খাই!” আম্মার খুবই মন খারাপ হয়ে যায়। আমাকে খেতে দিতে না পারার কষ্টটা তার চোখে মুখে বোঝা যায়। তখন আমারও মন খারাপ হয়, কিন্তু আমি যে লোভ সামলাতে পারি না! এক, দুইবার চুরিও করেছি। কিভাবে যেন আম্মা ঠিক ধরে ফেলে! কখনো আদর করে বোঝায়, কখনো অনেক রেগে যায়।
গু-এর এক কোনায় পা দিলে যা, পুরোটাতে পা দিলেও তাই, কেন বুঝিস না! তুই একটা খাস আর দুইটা ঐ চিংড়ি তো খাওয়া হলোই। কয়টা দিন ধৈর্য ধর মা!
আমার কান্না আসে, সেই সাথে আম্মাও মনে হয় কাঁদে। এসব চিন্তা করতে করতে মন খারাপ করে আমি ওদের সাতার দেখতে আসি আবার। কী মজা করছে ওরা। এখন পানি অনেক কম তাই দেয়ালের কিনার থেকে অত নিচে ওদের ভালো মত দেখাই যাচ্ছে না। কদিন পরেই শরত শুরু হবে, কাশফুলের ঘাসের ঝোপ একটু একটু দেখা যাচ্ছে নিচের মাটিতে, একটু বিচের মত, যেখানে ওরা সবাই।
আমি উদাস মনে শরত আগমনের চিন্তা করি। কী সুন্দর যে হয়, কাশফুলে দেয়ালের এই কোণাটা ভরে যায়। আম্মার কাছ থেকে ষড়ঋতুর নাম শিখেছি, কখন কেমন হয় তাও একটু একটু শিখেছি। সব ঋতুতে আম্মা বার বার মনে করিয়ে দেয়, এই যে এখন গ্রীষ্মকাল, এইযে দেখ এখন বর্ষা--। আর আমাদের বইয়ে একটা কবিতা ছিল শরতকাল নিয়ে, আমার তা খুবই প্রিয়-
ফুল কুল তুল তুল গা ভেজা শিশিরে,
বুল বুল মশগুল, কার গান গাহিরে?
তর বর উঠে পর রাত ভোর দেখ না?
হাত তুলে প্রাণ খুলে স্রষ্টারে ডাক না..
ঝিক মিক দশ দিক নাই পিক পাপিয়া..
সাদা বক চক চক উড়ে যায় ডাকিয়া..
বিল ঝিল খিল খিল লাল নীল বরণে,
গাছে গাছে ফিঙ্গে নাচে চঞ্চল চরণে।
ভেজা ভেজা তাজা তাজা শেফালির সুবাসে,
শিশুদল কোলাহল করে নানা হরষে।
টিদার জরিপার শ্যাম শাড়ী অঙ্গে
এ্যলো কেশে এলো হেসে শরত এ বঙ্গে..
সারাদিন মাথার মধ্যে কবিতাটা ঘুরে, শরত আসলেই মিলিয়ে মিলিয়ে দেখি। আমাদের বাংলা টিচার অনেক সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দেয়ালের কিনার থেকে কাশফুলগুলো ধরা যায় না, আমার যে কী ইচ্ছা করে ধরে দেখতে। মাঝে মাঝে ভাইয়ারা এনে দেয়, ওরা সব পারে! দেয়ালের এপাশের মাটিতে বসে কাশফুলগুলো দেখতেই থাকি, দেখতেই থাকি, মন কেমন করে! আর শরৎকালের আকাশ, কী যে সুন্দর! মেঘগুলো থেকে চোখ সরানো যায় না। আমি একা একা মেঘেদের সাথে কত কথা বলি। শরতকালে আমার এমন কেন লাগে! মনে হয় অনেক মন খারাপ! আবার মনে হয় অনেক আনন্দ! নীল আকাশের ঐ সাদা সাদা মেঘগুলোর সাথে কত কথা বলি। ঈস আমি যদি ঐরকম একটা কবিতা লিখতে পারতাম!
আমাদের একটা শেফালি ফুল গাছ আছে, সেটাও শরতের ফুল। অনেক বড় গাছ, লম্বা হয়ে উপরে উঠে গেছে, গোল ছাতার মত তার মাথাটা। সন্ধ্যায় সুবাসে চারিদিক ভরে যায়, আমাদের গলির মাথা থেকেই গন্ধ পাওয়া যায়। ভোরে যখন ফুল পরে থাকে, মনে হয় কেউ যেন সাজিয়ে রেখেছে। লম্বা উঠানটায় একটার পর একটা ফুল উপুড় হয়ে পড়ে থাকা, কমলা বোটাগুলো সব উপরে। একটা মাদুরের মত মনে হয়। কোন এলোমেলো ভাব নেই, মাঝে মাঝে একটার উপর আর একটা দেখা যায়। এমন করে ফুল বিছিয়ে থাকতে আমি আর কখনো দেখিনি। শরতকাল এত সুন্দর!!
আপনার মন্তব্য