ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা- ৮

রেজা ঘটক

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-১২ ১৫:৩৯:২১

 আপডেট: ২০১৫-১১-১২ ১৫:৪৩:৪৪

বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:

পূর্ব প্রকাশিতের পর...
বাবার কড়া চিঠি।


ইউনিভার্সিটি অব বেলগ্রেড স্কুল অব মেডিসিন বা সংক্ষেপে বেলগ্রেড স্কুল অব মেডিসিনের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য ছয় বছরের মেডিসিন কোর্স। ছয় বছর মেডিসিনের উপর পড়াশুনার পর আমরা পেলাম ডক্টর অব মেডিসিন বা সংক্ষেপে এমডি সার্টিফিকেট। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আমি ছিলাম এখানে একমাত্র স্টুডেন্ট। তাই অনেকেই আমাকে ইন্ডিয়ান মনে করত। কেবল কাছের বন্ধুরা জানত যে আমি আসলে নেপালী। যুগোশ্লাভ স্টুডেন্টেদের একই কোর্স পড়ানো হতো সাব্রো-ক্রোয়াট ভাষায়। আর আমার মত ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের পড়ানো হতো ইংরেজিতে।

বেলগ্রেড স্কুল অব মেডিসিনের বাইরে আমাদের আরও দুইটি জায়গায় ক্লাস হতো। যার একটি ছিল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ। অপরটি ছিল ইউনিভার্সিটি হসপিটাল সেন্টার। ইউনিভার্সিটি হসপিটাল সেন্টারে মূলত সোসাইটি অব ইয়ং উইমেন ডক্টরদের একটা আড্ডা ছিল। ক্লাস আর আড্ডার ফাঁকে সেখানেই আমার পরিচয় হয় রাফিয়ার সঙ্গে। রাফিয়া নার্সিং পাস করে ওই হসপিটালে ইন্টারনি করতে এসেছে। আমার চেয়ে প্রায় দুই ফুট লম্বা দীর্ঘাঙ্গী রাফিয়া পিরিক ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। এমনিতে যুগোশ্লাভ মেয়েরা নেপালী মেয়েদের চেয়েও সুন্দরী।
১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি হসপিটাল সেন্টারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুগোশ্লাভ ডক্টর দ্রাগিসা মিসোভিক-এর নামে নামকরণ করা হয়। ডক্টর দ্রাগিসা মিসোভিক পেশায় ডক্টর হলেও সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতেন। তিনি ছিলেন একজন জাত কমিউনিস্ট। পেশা হিসেবে ডাক্তারি আর রাজনীতি দুটোতেই তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হসপিটালে কর্মরত অবস্থায় তিনি জার্মানদের বোমা হামলায় নিহত হন। তাঁকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর এই কর্মস্থলের নাম তাই ডক্টর দ্রাগিসা মিসোভিক সেন্টার করা হয়। তখন থেকেই ইউনিভার্সিটি হসপিটাল সেন্টারটি আসলে ডক্টর দ্রাগিসা মিসোভিক সেন্টার নামেই পরিচিত।

রাফিয়ার সাথে এই ডক্টর দ্রাগিসা মিসোভিক সেন্টারেই আমার সবচেয়ে বেশি ডেটিং হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমি যখন বেলগ্রেডের ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ সেন্টারে চাইল্ড সাইসিয়াট্রির উপর উচ্চতর গবেষণা করি, তখন সেখানেও রাফিয়া প্রায়ই আসত। লাইব্রেরি থেকে বেড়িয়ে রাফিয়াকে নিয়ে চলে যেতাম ক্যাফেটারিয়ায় বা ক্যাম্পাসের কোনো নির্জন কোনে। ছয় বছর মেডিসিনের উপর পড়াশুনা করার পর আমি এখন পুরোদস্তুর ডাক্তার। চাইল্ড স্পেশালিস্ট হবার জন্য এখন ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ সেন্টারে বাড়তি পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের প্রেমের সম্পর্কও এখন তুঙ্গে।  

এর মধ্যে ১৯৭০ সালের ১০ নভেম্বর আমরা বিয়ে করি। পরদিন আমরা হানিমুন করতে যাই যুগোশ্লাভিয়ার একেবারে দক্ষিণের আদ্রিয়াটিক সাগরের তীরবর্তী শহর দুব্রোনিক কোস্টাল সাইডে। পরদিন ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের উপর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলো। সাফির সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী ওটা ছিল তিন মাত্রার ধ্বংসাত্মক হেরিকেন। পরবর্তী সময়ে ইতিহাসে যেটি ভোলা ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিতি পায়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বঙ্গোপসাগরের মুখে ছোট্ট ভোলা দ্বীপের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে এত মানুষ আর কোথাও একসঙ্গে মারা যায়নি। এই সময়ে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে একসঙ্গে বেশি মানুষ মারা যাবারও এটা সর্বোচ্চ রেকর্ড। প্রলয়ংকারী ওই ঘূর্ণিঝড়ে একসঙ্গে এত মানুষের মারা যাবার খবর শোনার পর, নিহতদের আত্মার প্রতি সম্মান রেখে আমরা হানিমুন সংক্ষিপ্ত করে বেলগ্রেড ফেরত আসলাম।

তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তান প্রায় রোজ বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হতে শুরু করলো। আমার আসলে প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল, বেলগ্রেড থেকে একটি মেডিকেল টিম নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার। কিন্তু পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ অস্থিতিশীল হওয়ায়, আর সদ্য বিয়ে করা রাফিয়াকে একা বেলগ্রেডে রেখে যাওয়ার মত পরিস্থিতির কারণে শেষ পর্যন্ত আমার আর পূর্ব পাকিস্তান যাওয়া হয়নি। তাছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সখ্যতা যতটা বেশি, সমাজতান্ত্রিক দেশ যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে যেন সখ্যতা ততটাই কম। যে কারণে সরকারি ভাবেও মেডিকেল টিম নিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য তেমন সাড়া পাওয়া কঠিন হতো। এত বড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মেডিকেল টিম নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে না পারার ব্যর্থতার কারণে, প্রায়ই পূর্ব পাকিস্তানের খবরাখবরের দিকে আমার নিয়মিত একটা নজরদারী বরং ওই ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকেই নিয়মিত হলো। আমি প্রায়ই পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতির খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলাম।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলো। আর এদিকে বেলগ্রেডে সেই দিনই রাফিয়া আমাকে আরেকটি সুখবর দিল। রাফিয়া ইজ প্রেগন্যান্ট। পরদিন বেলগ্রেডের ডক্টর দ্রাগিসা মিসোভিক সেন্টারে রাফিয়ার চেকআপ করালাম। হ্যা, সি ইজ প্রাউডলি প্রেগন্যান্ট। আমাদের প্রথম সন্তানের আগমনকে ঘিরে তখন আমার ভেতরেও নতুন উক্তেজনা শুরু হলো।

অনেকটা দুঃসাহস নিয়েই আমি কাঠমান্ডুতে মা-বাবা’র কাছে চিঠি লিখলাম। চিঠিতে লিখলাম যে, আমি এখানে বিয়ে করেছি। তোমরা তোমাদের নতুন বৌমাকে দেখার জন্য আগামী গ্রিস্মকালে জুন-জুলাই মাসের দিকে যুগোশ্লাভিয়া বেড়াতে আসো। এখানে এখন প্রচণ্ড শীত। কাঠমান্ডুর চেয়ে বেলগ্রেডের শীত কয়েক গুণ বেশি। কখনো কখনো মাইনাস ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হয়। চিঠি পোস্ট করার পর থেকে আমি বাবার চিঠির জবাবের প্রত্যাশায় রইলাম।

ওদিকে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত বাঙালি নেতা শেখ মুজিব? নাকি দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো? প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন প্রশ্নে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোলাটে হতে শুরু করলো। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালির উপর রাতের অন্ধকারে অপারেশান সার্স লাইটের নামে এক বর্বর হামলা করলো। গোটা বিশ্বের সংবাদ মিডিয়ায় পাকিস্তানের এই বর্বর হামলা ছবিসহ ছাপা হয়েছে। দ্য বেলগ্রেড নিউজ লিখেছে, অপারেশান সার্স লাইট শুরু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই রাতেই শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে বা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।   

৩১ মার্চ কাঠমান্ডু থেকে আসা বাবার চিঠি পেলাম। চিঠিতে বাবা আমাকে বিদেশি মেয়ে বিয়ে করার জন্য প্রচণ্ডরকম ভর্ৎসনা করলেন। বাবা লিখেছেন, আমার চার ছেলে এক মেয়ের মধ্যে তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। অথচ তুমিই কিনা আমাকে আজ প্রচণ্ড আঘাত দিলে। কাঠমান্ডুর সবাই আমাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করেন। সবাই জানে কৈলাস লোহানীর একটা ছেলে ডাক্তারি পাস করেছে। এটা গোটা কাঠমান্ডুর গর্ব। তাদের সবার প্রত্যাশা ডাক্তারি পাস করে তুমি কাঠমান্ডু এসে মানুষের সেবা করবে। অথচ তুমি কিনা একটা বিদেশি মেয়ে বিয়ে করে এখন ওখানেই বসবাসের চিন্তা করছ?

তোমার দুঃসাহসী স্পর্ধায় আমি বড় কষ্ট পেয়েছি, সুরেন। কাঠমান্ডুতে লোহানী পরিবারের একটি ঐতিহ্য আছে। আর তুমি কিনা সেই ঐতিহ্য ধূলায় মিশিয়ে দিলে! ডাক্তার সুরেন্দ্র লোহানীকে কাঠমান্ডুর মানুষ যেভাবে অন্তরে ঠাঁই দিয়েছে, যেভাবে কাঠমান্ডুবাসী এখন তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে, তুমি কী জানো তোমার এই খবর জানলে তারাও আমার মত কতোটা আহত হবে? কতোটা তাদের স্বপ্নভংগ হবে? তুমি বড্ড ছেলেমানুষি করেছ, সুরেন! তোমার এই বিয়ের খবরটি আমি কাঠমান্ডুতে কাউকে জানাতে পারব না। তোমার মাকেও আমি জানাতে চাইনি। কিন্তু পোস্টমাস্টার যখন তোমার চিঠি নিয়ে আসলেন, তোমার মা সবার আগে দেখেছে। তাই চিঠির ভেতরের সকল খবর শুনে তোমার মাও খুব কষ্ট পেয়েছে। এ তুমি কী করলে সুরেন?    
আমি জীবিত থাকতে কাঠমান্ডুতে তোমার ওই বিদেশি স্ত্রীর জন্য আমরা কেউ কোনো ধরনের অপেক্ষায় নেই। তোমার এত বড় অধপতনে আমি বড় ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। খবরদার, আমি জীবিত থাকতে কোনো দিন তুমি ওই বিদেশি মেয়ে নিয়ে কাঠমান্ডু আসার চেষ্টা করবে না। আমি কৈলাস লোহানী জীবিত থাকতে সেটা যেন তুমি স্বপ্নেও না ভাবো!

বাবার চিঠির জবাবে কী লিখব ঠিক বুঝতে পারছি না। বাবার কাছ থেকে জীবনে ওটাই ছিল আমার জন্য প্রথম কোনো ভর্ৎসনামূলক চিঠি। তাছাড়া বাবা খুব সিরিয়াস রিলিজিয়াস হিন্দু ব্রাহ্মণ। রাফিয়া যে মুসলিম মেয়ে এটা শুনলে বাবা আরো কষ্ট পাবেন। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম রাফিয়ার ধর্ম কী, এটা এই মুহূর্তে আর কাঠমান্ডুতে কাউকে কিছু বলব না।
|
বাবার চিঠি পড়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধের মত আমার হৃদয়ের গভীরেও এখন আরেকটি দুঃসহ দুর্বোদ্ধ সম্পূর্ণ অচেনা যুদ্ধ শুরু হলো। এই যুদ্ধ পিতৃ পরিচয়ের সামনে সন্তানের নিজস্ব পরিচয়ের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে মুসলিম বিদেশি মেয়ের গ্রহণযোগ্যতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ আমার সন্তানের ধর্ম কী হবে, হিন্দু ব্রাহ্মণ না মুসলিম, সেই ধর্মীয় বিবেচনা বোধের যুদ্ধ।
অথচ বাবার চিঠি আসার আগ পর্যন্ত এই বিষয়টি একবারও আমার মাথায় আসেনি। আমি একবারের জন্যও রাফিয়ার ধর্ম যে মুসলিম, আমার ধর্ম যে সনাতন, এটা নিয়ে ভাবিনি। কারণ রাফিয়ার সহজ সরল ধর্মহীনতাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়েছে। রাফিয়া মুসলিম হলেও রিলিজিয়াস কোনো প্রাকটিস সে করে না। রাফিয়ার পরিবারেও রিলিজিয়ান নিয়ে তেমন কারো মাথা ব্যথা নেই। তাই বিষয়টি আমার ভাবনায়ও সেভাবে কাজ করেনি।

বাবা নিশ্চয়ই ফিরতি চিঠিতে রাফিয়ার ধর্ম কী, তা সোজা সাফটা জানতে চাইবেন। সেই প্রশ্নের আমি কী জবাব দেব? বাবার সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়া কী সন্তান হিসেবে আমার অবশ্য কর্তব্য? বিগত প্রায় সাত বছর মাত্র দু’বার কাঠমান্ডুতে গিয়ে দু’বারই ঘরোয়া পূজা-অর্চনা ছাড়া ধর্মের আমি আর কতোটা বা পালন করেছি? ব্যক্তিগত জীবনে আমি নিজেই বা কতোটা ধার্মিক? হ্যা, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। কিন্তু অন্য কোনো ধর্মের প্রতি তো আমার কোনো বিদ্ধেষ নেই। কিন্তু বাবার চিঠিতে সেই রকম বিদ্ধেষের একটা প্রচ্ছন্ন হুংকার আছে। আমি কী বাবার হুংকারের কাছে এখন পরাজিত হব? সাত বছর ডাক্তারি বিদ্যায় তাহলে মানুষ হিসেবে আমি আসলে কী শিখলাম?

আমি যখন রোগী দেখি, তখন তো আমার সামনে কে কোন ধর্মের মানুষ, সেই বিষয়টি ভাবনায় আসার সুযোগ পায় না। তাহলে ব্যক্তিজীবনে আমি কেন সেই ধর্মীয় হীনমন্যতা পোষণ করব? না, ধর্ম নিয়ে এমন হীনমন্যতায় আক্রান্ত হওয়াটা আমার সাজে না। বাবার সন্তান হলেও আমার ধর্মীয় বিবেচনাটি কী হবে, সেটি একান্ত আমার ব্যক্তিগত হওয়াই যুক্তিযুক্ত। রাফিয়া তো কখনো আমার ধর্ম নিয়ে একবারও প্রশ্ন তোলেনি। রাফিয়ার বাবা মিস্টার সোলায়মান সাহেব তো আমার ধর্ম নিয়ে একটা বাক্যও ব্যয় করেননি। রাফিয়ার মা মিসেস হাইরিয়া আমার বাবার মত একজন সিরিয়াস রিলিজিয়াস মুসলিস। মিসেস হাইরিয়া তো একবারও আমার ধর্ম নিয়ে একটা প্রশ্নও তুললেন না। তাহলে আমি কেন বাবার ধর্ম নিয়ে এত বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেব? আমার সন্তান কোন ধর্ম পালন করবে তা নিয়ে কেন আমি এখন মহাসাগরে হাবুডুবু খাব?

এই যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি বাঙালি শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। গোটা কলকাতা ও আগরতলায় এখন বাঙালি শরনার্থীদের অভয় আশ্রয়কেন্দ্র। ভারত সরকার কী একবারও মুসলমান বলে কাউকে পাকিস্তানে তাড়িয়ে দিয়েছে? কিংম্বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে আলাদা খাতির করতে পেরেছে? পারেনি। বরং মানবতার প্রশ্নে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী দারুণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে এখন রক্তের বন্যা বইছে। সেখানে পাক সেনাদের কাছে মুসলিম হিন্দু উভয় ধর্মের মা-মেয়েরাই ধর্ষিত হচ্ছে। কই, সেখানে তো ধর্মের ব্যাপারটি আসেনি। বিশ্ব মানবতার কোথাও তো ধর্মের দোহাই নেই। তাহলে আমি কেন ধর্মীয় প্রশ্নে এখন বাবার কাছে নত হব? আমার সন্তানের ধর্ম কী হবে, তা নিয়ে আমার কেন এখন এত টেনশন হবে? না, এ নিয়ে আমি আর ভাবতে পারছি না। বাবাকে এখন কিছুতেই আর ক্ষেপানো যাবে না। বিষয়টি ডিপলোমেটিক হিসেবে নিতে হবে। বরং বাবার চিঠির জবাব আরো কয়েক সপ্তাহ পরে দেব। আরো ভেবে চিন্তে তারপর দেব।

আগের পর্বের লিংকসমূহ

বসনা- ১

বসনা- ২

বসনা-৩



বসনা- ৪


বসনা- ৫


বসনা- ৬


বসনা-৭

আপনার মন্তব্য