ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা-৫

রেজা ঘটক

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-১৫ ০২:৫৬:০২

 আপডেট: ২০১৫-০৮-১৫ ০৩:২১:৪৮

বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:

[... পূর্ব প্রকাশিতের পর]

আমাদের সামনের সেই বাসে একটি কুঁড়ি-একুশ বছরের মেয়ে ভয়ে নামতে একটু দেরি করেছিল। একজন সার্ব সেনা মেয়েটিকে টেনেহিচড়ে নামালো। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চারজন সার্ব সেনা মেয়েটিকে সবার সামনে উলঙ্গ করলো।

পাশে সারি করে দাঁড়ানো সার্ব সেনাবাহিনীর একটা গাড়ির পেছনের হুটের সঙ্গে ওই চারজন সার্ব সেনা মেয়েটিকে আটকে ধরলো। অন্য তিন জন সার্ব সেনা ওই অবস্থায় মেয়েটিকে পরপর ধর্ষণ করলো। তারপর মেয়েটিকে অন্য বাছাই করা মেয়েদের সারিতে নিয়ে গেল। মেয়েটি তখনো ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল।

মেয়েদের সেই সারি থেকে একটি মেয়ে সেই ধর্ষিত মেয়েটিকে তার মাথার স্কার্ফ দিল আব্রু নিবারণের জন্য। কিন্তু মেয়েটি সেই স্কার্ফ দিয়ে কি করবে বুঝতে পারছিল না। শুধু থরথর করে কাঁপছিল। মেয়েদের সেই সারি থেকে কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে তাদের ওড়না আর স্কার্ফ দিয়ে মেয়েটিকে আব্রু নিবারণে সহযোগিতা করলো।

একজন তরুণ সার্ব সেনা আমাদের বাসের সামনে এসে একটা নির্দেশনা ঘোষণা করলো। তরুণ সার্ব সেনাটির হাতে একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। কোমরে পিস্তল। তরুণ সেনাটি ঘোষণা করলো- আমি যেভাবে নির্দেশ দেব, আপনারা সেভাবে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। না করলে কপালে কি ঘটবে তা একটু আগে চোখের সামনেই দেখতে পেয়েছেন। যাদেরকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হবে, খুব দ্রুত সেভাবে তা পালন করবেন। নইলে আমরা গুলি করতে বাধ্য হব।

ছেলেটির কথা শুনতে শুনতে ভালো করে তাকিয়ে দেখি ছেলেটি আমার পরিচিত। আমার স্কুলের ছাত্র। আমার চেয়ে দু’ক্লাস উপরের ছাত্র সে। ছেলেটির নাম গোরান মিয়াসভিচ। গোরান একজন অর্থোডক্স সার্ব। গোরান যে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে তা আমি জানতাম না। জানার উপায়ও ছিল না। গোরান পড়ে টুয়েলভ ক্লাসে। আর আমি ক্লাস টেন। দেড় মাসও হয়নি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অথচ এই কয়টা দিনের মধ্যেই গোরান এভাবে পাল্টে গেছে। আমি ভাবতেই পারছি না গোরান এখন একজন সার্ব সেনা।

গত প্রায় দু’বছর ধরে গোরান আমাকে প্রেম নিবেদন করে আসছিল। আমি গোরানকে একদম পাত্তা দেইনি। গোরান একটু বখাটে টাইপের। পড়ালেখায় মোটেও ভালো না। সারাদিন দুষ্টামি আর বানরামি করে কাটায়। গোরানদের একটা দুষ্টু ছোকড়ার গ্রুপ আছে। ওই গ্রুপের প্রায় সবাই দুষ্টু আর মাস্তান প্রকৃতির। যে কারণে, গোরানকে পছন্দ হবারও কোনো কারণ ছিল না।

কিন্তু গোরান একবার বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার সময় আমাকে বলেছিল, কেউ যদি তোমাকে ডিসটার্ব করে, আমাকে শুধু তার নাম বলবা। আমি তার হাড়-মাংস আলাদা করে দেব। কারণ তুমি জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। যদিও তুমি আমাকে একদম পাত্তা দাও না। তবুও কেউ যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, আমাকে সেই খবর দিবা। তারপর দেখবা, আমি কি করতে পারি। সেই গোরানও তার সার্ব সেনাবাহিনী আমাদের বাসের সামনে এখন দাঁড়িয়ে।

একটু আগে যে মেয়েটিকে ওর দলের সেনাগুলো ধর্ষণ করলো, তখনো গোরান ওপাশে দাঁড়িয়ে নানা ধরনের নির্দেশ দিয়েছিল। আমাদের বাস থেকে একটু দূরের ঘটনা হওয়ায় তখন গোরানকে ভালো মত চিনতে পারিনি। কিন্তু এখন স্পষ্টভাবেই গোরান আমাদের বাসের সামনে দাঁড়িয়ে। মনে মনে বারবার সুরা ফাতেহা পড়ছি আর বুকে ফুঁ দিচ্ছি। কপালে কি আছে কিছুই জানি না।

ছোটখালার কোলে আহমেদ। ছোটখালার আঁচল ধরে পেছন পেছন আমি। পৃথিবীর সকল ভয়ের সর্বোচ্চ আতংক নিয়ে গা ঘেঁষে ছোটখালার পেছন পেছন বাস থেকে নামছি। আমাদের বাস থেকে সবার নামা শেষ হলে দুই জন সার্ব সেনা বাসের মধ্যে ঢুকে তন্ন তন্ন করে সব কিছু তল্লাশি করলো। বাসের ভেতর থেকে রিফিউজিদের কিছু ঝোলা হাতে নিয়ে তারা নামলো। ঝোলা খুলে তল্লাশি করলো। কোন ঝোলা কার, কেউ কিছু স্বীকার করলো না। কেউ দাবী করলো না ওটা আমার ঝোলা।

একটা ঝোলার মধ্যে সার্ব সেনারা একটা রুবি’র আংটি পেল। সেই আংটি সেনাটির হাত থেকে গোরান নিল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে এসে গোরান জিজ্ঞেস করলো, এই আঙটি কার? রিফিউজিদের থেকে কেউ টু শব্দ করলো না। তিনবার আঙটি দেখিয়ে গোরান জানতে চাইলো- এই আঙটি’র কেউ মালিক আছে এখানে? কেউ কোনো টু শব্দ করলো না। গোরান আঙটি নিজের পকেটে রেখে দিল।

আমাদের বাসের রিফিউজি দল থেকে চারটি মেয়েকে ওরা আলাদা করলো। আলাদা করা অন্য বাসের মেয়েদের সারিতে নিয়ে গেল তাদের। দুইজন বয়স্ক পুরুষকে আলাদা করলো। আর একটি উঠতি বয়সের তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলেকে আলাদা করে পুরুষদের সারিতে নিয়ে গেল গোরানদের সার্ব সেনারা।

এসবের মাঝে গোরান মাঝে মাঝে চোরা চাহনিতে আমাকে দেখছিল। গোরান যতোবার আমার দিকে তাকায় ততোবার ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে যায়। এই বুঝি আমাকেও আলাদা সারিতে নেওয়ার জন্য গোরান নির্দেশ দেয়। সেই আতংকে আমি গুটিশুটি মেরে ছোটখালার শরীরের সাথে একেবারে লেপ্টে দাঁড়িয়েছি।

বাস থেকে যাদের আলাদা করা হয়েছে তাদের ভাগ্যে কি আছে কেউ বলতে পারে না। হয়তো পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হবে। আর মেয়েদের ওরা ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। সেখানে যার যখন খুশি ধর্ষণ করবে ওদের। ওদের জামাকাপড় পরিস্কার করাবে। ওদের ভাগ্যে কি হবে একমাত্র গড ছাড়া কেউ জানে না।

খেয়াল করলাম গোরান চারজন সার্ব সেনার সঙ্গে কিছু একটা পরামর্শ করছে। আর পরামর্শের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে ইঙ্গিত করে কিছু একটা নির্দেশনা দিচ্ছে। আমার তখন হার্ট ফেল করার মতো দশা। আমি আর ওদিকে না তাকিয়ে ছোটখালার শরীরে সঙ্গে আরো লেপ্টে গেলাম। পুরো শরীর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।

কয়েক মুহূর্ত পর গোরান আমাদের কাছে আসলো। সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলো- তোমার সঙ্গে আর কে কে আছে? আমি কোনো জবাব না দিয়ে শক্তহাতে ছোটখালাকে ধরলাম। ছোটখালা গোরানের প্রশ্নের জবাব দিল। আমরা তিন জন। এরপর গোরান আমাদের তিন জনকে একটু সামনে আসার নির্দেশ দিল। ছোটখালার গায়ে গায়ে দু’পা সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।গোরান পকেট থেকে সেই আঙটিটা বের করে আমার হাতে দিল। আর বললো- এটা তোমার কাছে রাখবা। যাও, তোমরা গিয়ে বাসে বসো। 

এরপর ছোটখালা, আহমেদ আর আমি আমাদের বাসে গিয়ে বসলাম। গোরানের দেওয়া সেই রুবি’র আঙটি তখনো আমি মুঠি করেই ধরা। আঙটিটা কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু পরে অন্য রিফিউজিরা আমাদের বাসে এসে আগের মত বসলো। আমাদের বাস একটু সামনে এগিয়ে তল্লাশি হয়ে যাওয়া অন্য বাসের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠিক তখুনি আমাদের ঠিক ডানপাশে বসা চল্লিশ বছরের মত বয়স্কা এক বসনিয়ান মহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ওটা আমার আঙটি। আমাকে ফিরিয়ে দাও।

আঙটি নিয়ে ছোটখালা আর সেই মহিলা কিছুক্ষণ তর্ক হল। এক পর্যায়ে ওই মহিলা বললো- ওই আঙটি তুই নিলে তোর মরণ হবে। তোকে আমি এই অভিশাপ দিচ্ছি। ওদিকে আমাদের পেছনের বাসে তখন আগের মত গোরানরা তল্লাশি চালাচ্ছিল। ওই মহিলার কথা শুনে আমি রাগে ক্ষোভে বাসের মধ্যে সেই আঙটি ছুড়ে মারলাম। মহিলা দৌড়ে গিয়ে সেই আঙটি কুড়িয়ে নিল।

প্রায় দেড় ঘণ্টা আমরা বাসের মধ্যে ওভাবে বসে রইলাম। সকল বাসের তল্লাশি শেষ হলে আমাদের বাসের কাছে আবার গোরান আর চারজন সার্ব সেনা আসলো। বাসের জানালা থেকে আমাকে উদ্দেশ করে বললো- পথে আমাদের আরো লোকজন হয়তো তোমাদের তল্লাশি করবে। তুমি কোনো টেনশান করো না। আমাদের দলের সবাইকে তোমার কথা আমি বলে দেব। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। আর আঙটিটা তোমার কাছে রেখো। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছিল। এর একটু পরেই আমাদের বাস অজানা উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল।

আগের পর্বগুলোর লিংক:

বসনা-১ || বসনা-২ || বসনা- ৩ || বসনা- ৪

আপনার মন্তব্য