বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা: (প্রথম পর্ব: নির্ভারতা ও ভার – ৮ এবং ৯ )

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-১২ ১১:১৯:০০

 আপডেট: ২০১৬-০২-০৮ ১৩:২৮:২২

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা: (প্রথম পর্ব : নির্ভারতা এবং ভার - ৬ এবং ৭) এর পর

দিনের বেলায়, তেরেজা চেষ্টা করতো (যদিও শুধুমাত্র আংশিক সফলতার সাথে) টমাস তাকে যা বলছে, তা বিশ্বাস করার জন্য এবং চেষ্টা করতো আগে যেমন সে ছিল তেমন উচ্ছল থাকতে। কিন্তু দিনের বেলায় তার এই পোষ মানানো ঈর্ষা হিংস্র রূপ নিয়ে আক্রমণ করতে বেরিয়ে আসতো তার স্বপ্নে, যার প্রতিটি শেষ হতো বিলাপে, একমাত্র ঘুম ভাঙ্গিয়েই টমাস তা থামাতে পারতো।

তেরেজার স্বপ্নগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটতো, তাদের বিষয়বস্তু আর বিভিন্নতায় অথবা কোনো টেলিভিশন সিরিজের মত। যেমন, বার বার তেরেজা স্বপ্ন দেখতো যে, কতগুলো বিড়াল তার মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধারালো নখ নৃশংসতার সাথে মুখের চামড়ায় বসিয়ে দিচ্ছে । স্বপ্নটির ব্যাখ্যা করতে আমাদের  খুব বেশী দূর যেতে হবে না। কারণ চেক অপভাষায়‘বিড়াল‘ শব্দটির আরেকটি অর্থ হলো,’সুন্দরী রমণী’; নারী, যে কোন নারীকে, তেরেজা হুমকি হিসাবে অনুভব করতো। কারণ যে কোনো নারীই হতে পারে টমাসের সম্ভাব্য প্রেমিকা এবং তাদের সবাইকে নিয়ে সে শঙ্কিত।
অন্য আরেকটি স্বপ্ন চক্রে, তেরেজা দেখে, তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

একবার,গভীর রাতে তার শঙ্কিত আর্তচিৎকার শুনে টমাস তার ঘুম ভাঙ্গায়, তাকে তার দুঃস্বপ্নের কথা বলে তেরেজা: ‘আমি একটা বিশাল ইনডোর সুইমিং পুলে, সেখানে আমরা প্রায় বিশ জন এক সাথে, সবাই নারী, সবাই নগ্ন, পুলটি চারপাশে আমাদের সারি বেধে মার্চ করে হাটতে বাধ্য করা হচ্ছে, পুলের ছাদ ঝুলে আছে থেকে একটা বিশাল ঝুড়ি, সেখানে দাড়িয়ে আছে মাথায় প্রশস্ত প্রান্তসহ টুপি পরা একজন পুরুষ, টুপিটা তার মুখটাকে প্রায় আড়াল করে রেখেছে, কিন্তু আমি দেখতে পারছিলাম, সেই মানুষটি ছিলে তুমি। ওখান থেকে তুমি আমাদের নির্দেশ দিচ্ছিলে, চিৎকার করে। পুলের পাশ দিয়ে মার্চ করে হাটার সময় আমাদের গান গাইতে এবং হাঁটু ভেঙ্গে একটা অনুশীলন করতে বাধ্য করা হয়। যদি আমাদের মধ্যে কেউ ঠিক মত অনুশীলনীটা না করতে পারে, তুমি তোমার হাতের পিস্তল দিয়ে তাকে গুলি করছো, আর পুলের পানিতে তার মৃতদেহ পড়ে যাচ্ছে।

যা দেখে আবার সবাই হেসে উঠছে আর আরো উচ্চস্বরে গান গেয়ে উঠছে। তুমি আমাদের দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যও নজর ফেরাচ্ছো না, যে মুহূর্তে আমরা ভুল কিছু করছি, তুমি গুলি করছো, পুলের পানির পৃষ্ঠদেশের ঠিক নীচের অংশটি পূর্ণ অসংখ্য  মৃতদেহে। এবং আমি বুঝতে পারছি, আমার আর শক্তি নেই এর পরের বার হাঁটু ভাঙ্গার অনুশীলনীটা করার মত, আর তুমি আমাকে তখনই গুলি করতে যাচ্ছো !’

পরে তৃতীয় চক্রের কোন একটি স্বপ্নে তেরেজা দেখে, সে মৃত। আসবাবপত্র স্থানান্তর করার জন্য ব্যবহার হয় এমন একটি বিশাল ভ্যানের মত শবদেহবাহী গাড়ির মধ্যে শুয়ে আছে মৃত তেরেজা, তার চারপাশে আরো মৃত নারীরা। মৃতদেহের সংখ্যা এত বেশী যে, ভ্যানটির পেছনের দরজাটি ঠিকমতন লাগানো যাচ্ছে না, বাইরের দিকে কিছু লাশের পা ঝুলে আছে শূন্যে। তেরেজা চিৎকার করে বলে, ‘আমি মরিনি, আমি এখনও সবকিছু অনুভব করতে পারছি’। অন্য লাশগুলোও সাথে সাথে হেসে উঠে বলে, ‘আমরাও পারছি’। তাদের সবার হাসি সেই হাসির মত, যে হাসি হেসে জীবিত রমণীরা খুব উৎফুল্ল মনে তাকে একসময় বলতো, খুবই স্বাভাবিক যে একদিন তারও বাজে দাঁত হবে, ডিম্বাশয় কর্মক্ষমতা হারাবে, আর ভাজ পড়বে চামড়ায় কারণ তাদের সবারও  দাঁত বাজে, ডিম্বাশয় অকেজো আর চামড়ায় ভাজ। সেই একই হাসি হেসে মৃত রমণীরা তাকে বলে, সে এখন মৃত, সব কিছু খুব স্বাভাবিকই আছে!

হঠাৎ করে তেরেজা প্রস্রাব করার তীব্র তাড়না অনুভব করে, চিৎকার করে তেরেজা তাদের বলে, ‘তোমরা দেখেছো, আমার প্রস্রাব করতে হবে, সেটাই আমার বেঁচে থাকার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ!’

তারা শুধু আরো একবার হেসে ওঠে তার কথায়,  ‘প্রস্রাব করতে চাওয়াটাও খুব স্বাভাবিক’, তারা বলে, ’তুমি আরো অনেকদিন ঠিক এমন কিছু তাড়না  অনুভব করে যাবে। যেমন একজন হাত কেটে ফালা মানুষ, দীর্ঘদিন অনুভব করে যায়, হাতটি আগের মতই সেখানে আছে। আমাদের শরীরের মধ্যে এক ফোটা প্রস্রাব না থাকতে পারে, কিন্তু প্রস্রাব করার প্রয়োজনীয়তা ঠিকই আমরা অনুভব করেই যাবো।’

বিছানায় তেরেজা টমাসের আরো কাছে সরে এসে শোয়। তেরেজা বলে ‘এবং যেভাবে তারা আমার সাথে কথা বলছিল, যেন আমার বহুদিনের পুরনো বন্ধু, আমাকে সারা জীবন ধরে যারা চেনে আর জানে,আর তাদের সাথে আমার অনন্তকাল একসাথে থাকতে হবে, এমন ভাবনা আমাকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল।’



ল্যাটিন থেকে উৎপত্তি হয়েছে এমন সব ভাষাগুলো, compassion বা ‘সমবেদনা’  শব্দটি তৈরি করেছে - একটি প্রিফিক্স বা উপসর্গ, যার অর্থ ‘এক সাথে’ বা ‘সহ বা সম’ (com-) এবং একটি রুট বা  মূল শব্দ যার অর্থ ‘কষ্ট বা বেদনা’ ( ল্যাটিন, passio)  সংযুক্ত করে। কিন্তু অন্য ভাষাগুলোয় - যেমন- চেক, পোলিশ, জার্মান এবং সুইডিশ ভাষায় এই শব্দটি বোঝাতে একটি বিশেষ্য পদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা তৈরি হয়েছে প্রায় একটি সমার্থক (ল্যাটিন উপজাত ভাষার মত) উপসর্গ এবং অপর একটি শব্দ যার অর্থ  ‘অনুভূতি’ ( চেক, Sou-cit; পোলিশ, współ-czucie, জার্মান, Mit-gefül, সুইডিশ, med-känsla)।

ল্যাটিন থেকে উদ্ভূত ভাষাগুলোয় ‘কমপ্যাশন’ শব্দটির অর্থ: অন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে এমন ব্যাপারটি আমরা শুধু শীতলভাবে দেখে যেতে পারিনা বা যারা কষ্ট পাচ্ছে, আমরা তাদের সমব্যথী হই; আরেকটি শব্দ যার প্রায় একই রকম অর্থ, তাহলো ‘পিটি (pity) বা করুণা’ ( ফরাসী pitié; ইতালীয়, pietà, ইত্যাদি), যেখানে কোনো ভুক্তভোগীর প্রতি এক ধরনের অবনমন প্রক্রিয়া কাজ করে, যেমন: ‘এই মহিলার প্রতি করুণা করুন, এর অর্থ, আমরা তার চেয়ে অনেক ভালো আছি, আমাদের তার পর্যায়ে আসতে হবে, বা নিচে নামিয়ে ফেলতে হবে আমাদের’।

সে কারণেই ’কমপ্যাশন’ শব্দটি প্রায়শই সন্দেহের উদ্রেক করে। এমন একটা অনুভূতিকে এটি নির্দিষ্ট করে দেয় যা মনে করা হয় অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর, ভালোবাসার সাথে যার সংশ্লিষ্টতা খুবই সামান্য। কাউকে সমব্যথী হয়ে বা সমবেদনার ( অর্থাৎ কমপ্যাশন) কারণে ভালোবাসার অর্থ আসলে, ভালো না বাসা।

যে ভাষাগুলোয় ‘কমপ্যাশন’ শব্দটি তৈরি করেছে মূল শব্দ ‘কষ্ট বা সাফারিং’ থেকে নয়, বরং মূল ‘ফিলিং বা অনুভূতি’ থেকে, সেই শব্দগুলোও  প্রায় একই রকমভাবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, এই শব্দগুলো যে একটি খারাপ বা নিম্নমানের ভাবাবেগকে চিহ্নিত করছে, সেটা নিয়ে তর্ক করাটা বেশ কঠিন । শব্দটির উৎপত্তি সংক্রান্ত অর্থটির গোপন শক্তি, শব্দগুলোকে অন্য এক অর্থের আলোয় উদ্ভাসিত করে এবং এর অর্থকে দেয় বিশালতা: কারো প্রতি ‘সমবেদনা বা কমপ্যাশন’ (সহ অনুভূতি) অর্থ শুধু আরেকজনের দুর্ভাগ্যর সাথে বসবাস করাই না বরং তার সাথে একাত্ম হয়ে তার যে কোনো অনুভূতিকে সমান ভাবে অনুভব করা-                   

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      
আনন্দ, দুশ্চিন্তা , সুখ, যন্ত্রণা। এই ধরনের ’কমপ্যাশন’ (Sou-cit, współ-czucie, Mit-gefül, med-känsla শব্দগুলো যে অর্থে) সেকারণে ইঙ্গিত দেয়, অনুভূতি ও সহানুভূতির সর্ব্বোচ্চ কল্পনাক্ষমতার ও আবেগীয় এক টেলিপ্যাথি বা দুর অনুধাবনের। ভাবাবেগের প্রাধাণ্যপরম্বপরার স্তরবিন্যাসে, তাহলে, এর অবস্থান সবার শীর্ষে।

টমাসের কাছে তার নখের নীচে সুচ ফোটানোর স্বপ্নের বিবরণ দিয়ে, তেরেজা, নিজের অনিচ্ছাতেই প্রকাশ করে ফেলেছিল, সে তার টেবিলের ড্রয়ারের জিনিসপত্র ঘেঁটেছে। যদি তেরেজা না হয়ে অন্য কোনো নারী এই কাজটি করতো, টমাস তার সাথে আর কখনোই কথা বলতো না, সেটা জেনেই তেরেজা, তাকে বলে, ‘আমাকে তাহলে বের করে দাও!’ । কিন্তু টমাস তাকে বের করে দেবার বদলে, তার হাত ধরে, আঙ্গুলগুলোর মাথায় চুমু খায়, কারণ সেই মুহূর্তে টমাস নিজেও তেরেজার নখের নীচের সেই কষ্ট অনুভব করেছিল সুস্পষ্টভাবে, যেন তেরেজার আঙ্গুলগুলো  স্নায়ু সরাসরি তার নিজের মস্তিষ্কে প্রবাহিত করেছে সেই অনুভূতিটাকে।

যে কেউ, যারা শয়তানের এই উপহার, ‘সমবেদনা বা কমপ্যশন’ (সহানুভূতি বা কো-ফিলিং) এর সুবিধা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা তেরেজাকে তার কাজের জন্য শীতলভাবেই দোষী সাব্যস্ত করতে কোন দ্বিধা করবেনা, কারণ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা অত্যন্ত পবিত্র একটা জিনিস, এবং টেবিলের ড্রয়ার, যেখানে অন্তরঙ্গ চিঠিপত্র থাকে তা কখনোই খোলা উচিৎ না। কিন্তু টমাসের নিয়তি ( বা অভিশাপ) যেহেতু ‘কমপ্যাশন বা সমবেদনা’, সে অনুভব করেছিল, যেন সে নিজেই টেবিলের এর খোলা ড্রয়ারের সামনে নতজানু হয়ে আছে, সাবিনার লেখা চিঠিগুলো থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। সে  তেরেজাকে বুঝতে পেরেছিল, তার উপর রাগ করে থাকতে, টমাস শুধু অক্ষমই না, সে তাকে আরো বেশী ভালবেসেছিল।

আপনার মন্তব্য