বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা: (প্রথম পর্ব: নির্ভারতা ও ভার – ১১)

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-২৪ ১৪:৫১:৫৪

 আপডেট: ২০১৬-০২-০৩ ০৩:১১:৪৪

কাজী মাহবুব হাসান:

আগের পর্বের পর

১১
তেরেজার কষ্টকে খানিকটা সহনীয় করার প্রচেষ্টায় টমাস তাকে বিয়ে করে ( এবং অবশেষে তারা তেরেজার জন্য ভাড়া করা সেই রুমটা ছেড়ে দিতে সক্ষম হয়, যদিও তেরেজা সেখানে রাত কাটায়নি বহুদিন হলো) এবং তাকে একটা কুকুর ছানাও উপহার দেয়।

তার এক সহকর্মীর সেন্ট বার্নার্ড জাতের পোষা কুকুরের গর্ভে জন্ম নেয়া শাবকগুলোর পিতা অবশ্য তার প্রতিবেশীর জার্মান শেপার্ডটি ।কেউই এই মিশ্র জাতের এই ছোট কুকুর ছানাগুলোকে চাইছিল না এবং তার সহকর্মীও এদের মেরে ফেলার কথা সহজে ভাবতেও চাইছিল না।

কুকুর ছানাগুলোকে যেদিন টমাস প্রথম দেখেছিল, টমাস জানতো যে, সে যাদের বাতিল করবে তাদের নিয়তিতে রয়েছে অনিবার্য মৃত্যু।  নিজেকে তার মনে হয়েছিল যেন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট, চারজন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বন্দীর সামনে দাঁড়ানো, মাত্র একজনের জীবন বাঁচানোর যার ক্ষমতা আছে।

অবশেষে টমাস এদের একজনকে বেছে নেয়:  একটা মেয়ে কুকুর ছানা, যার দেহের গড়ন জার্মান শেপার্ড এর কথা মনে করিয়ে দেয় এবং মাথাটি মা সেন্ট বার্নার্ড জাতের মত। তেরেজার জন্য সে এটিকে বাসায় নিয়ে আসে, দেখামাত্রই তেরেজা তাকে বুকে তুলে নেয়, ছানাটি সাথে সাথে তেরেজার কাপড়ে প্রস্রাব করে দিয়েছিল।

এরপর দুজনে মিলে এর একটি নাম ঠিক করার চেষ্টা করে। টমাস চাচ্ছিল, এর নাম এমন হবে যেন স্পষ্ট বোঝা যায় এটি তেরেজার কুকুর এবং সে ভাবছিল তেরেজা যখন প্রথমবারের মত প্রাহাতে না বলে চলে এসেছিল, তখন তার বাহুর নীচে চেপে ধরে রাখা বইটার কথা; সেটা ভেবেই টমাস প্রস্তাব করে, তারা এই কুকুর ছানাকে ডাকবে টলস্টয় [২২]।
তেরেজা প্রতিবাদ করে বলে, ‘এর নাম টলস্টয় হতেই পারেনা, কারণ, ও তো মেয়ে, আনা কারেনিনা [২৩] বলে ডাকলে কেমন হয়?’

টমাস বলেছিল, ‘এর নাম আনা কারেনিনা হতেই পারে না, কোন রমনীর এত হাস্যকর মুখশ্রী হতে পারেনা, বরং এর চেহারা অনেকটা কারেনিনের মত, হ্যা, আনার স্বামী, ঠিক এভাবেই আমি তার চেহারাটা কল্পনা করেছিলাম’।

‘কিন্তু কারেনিন বলে ডাকলে কি বিষয়টা তার লিঙ্গ পরিচয়ে কোন সমস্যা সৃষ্টি করবে নাতো আবার’?
তেরেজার এই প্রশ্নের জবাবে টমাসের উত্তর ছিল, ‘খুবই সম্ভব, হতে পারে সেটা, একটা মেয়ে কুকুরকে সারাক্ষণ কোনো ছেলেদের নাম ধরে ডাকলে, সে নারী সমকামিতার বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতে পারে’।

বিস্ময়কর ব্যাপার, টমাসের কথা সত্যিও হয়েছিল। যদিও মেয়ে কুকুর ছানারা সাধারণত তাদের নারী মনিবের তুলনায় বেশী পুরুষ মনিব ঘেঁষা, কারেনিনকে দেখা গেল এর ব্যতিক্রম, স্পষ্টতই সে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে যে, তেরেজাকে সে বেশী ভালোবাসে। এজন্য টমাসও কারেনিনের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়ে টমাস বলতো, ‘সাবাশ, কারেনিন! আমি তোমার কাছে এটাই চেয়েছিলাম, যেহেতু আমি একা তেরেজার সাথে সামলে উঠতে পারছি না, আমাকে তোমার অবশ্যই সাহায্য করতে হবে’।

কিন্তু এমন কি কারেনিন এর সাহায্য নিয়েও টমাস তেরেজাকে সুখী করতে ব্যর্থ হয়। সে তার এই ব্যর্থতাটার স্বরূপটা প্রথম বুঝতে পারে, আরো কয়েক বছর পর, আগ্রাসী রুশ সামরিক ট্যাঙ্ক বাহিনীর তার দেশটিকে দখল নেবার প্রায় দশ দিনের মাথায়। সেটা ছিল, ১৯৬৮ সালের আগষ্ট মাস এবং টমাস জুরিখের একটি হাসপাতাল থেকে প্রায় প্রতিদিনই ফোন পাচ্ছিল। সেখানের এক হাসপাতালের পরিচালক ও একজন চিকিৎসক, টমাসের সাথে যার বন্ধুত্ব হয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সময়, রুশদের চেক আগ্রাসনের সময় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন ছিলেন টমাসকে নিয়ে, একারণে বার বার তাকে জুরিখে কাজ দেবার প্রস্তাব করছিলেন।
 
(চলবে)

নোটস:
[২০] যদিও লিবার্টিনের নানা নেতিবাচক আভিধানিক অর্থের সাথে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু লিবার্টিনিজিম দর্শন হিসাবে বহু বিবর্তিত হয়েছে সুইস ধর্মসংষ্কারক জন কেলভিন কতৃক তার বিরোধীদের চিহ্নিতকারী শব্দ থেকে। লিবার্টিনরা প্রথমত বৃহত্তর সমাজ দ্বারা অনুমোদিত নানা আচরণ বিধি ও অনুসৃত নৈতিকতার উপেক্ষা,বিরোধিতা ও বর্জন করে। পরবর্তীতে লিবার্টিন শব্দটি দিয়ে সেই সব মানুষকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতো যারা কোনো ধরণের নৈতিকতার বিধি নিষেধ মানতেন না, যা তারা মনে করতেন অপ্রয়োজনীয় এবং অনাকাংঙ্খিত। ইন্দ্রিয়ানুভূতি সংশ্লিষ্ট আনন্দ অনুসন্ধানে যারা বিশেষ সচেষ্ট।
[২১] ট্রিস্টান এর প্রতি এই তথ্যসূত্রের ইঙ্গিত এসেছে মধ্যযুগীয় কিংবদন্তীর কাহিনী ট্রিস্টান ও ইসোলডে থেকে, যেখানে ট্রিস্টান, মধ্যযুগীয় এই নাইটকে, আমরা দেখবো দেখবো ইসোলদের একনিষ্ঠ প্রেমিক হিসাবে (রোমান্টিক বিরোচীত এই ভালোবাসার কাহিনী বার বার নানা মহাকাব্যে আবির্ভূত হয়েছে ( যেমন ল্যান্সেলট ও গুয়েনেভির); এই উপন্যাসটি আরো অগ্রসর হলে আমরা বুঝতে পারবো এখানে কুন্দেরা আসলেই সাবিনার মুখ দিয়ে টমাসের চরিত্রটি সম্বন্ধে চুম্বক একটি ধারণা দিয়েছেন, আমরা টমাসে চরিত্রে ডন হুয়ানকে যেমন দেখি, তেমনি ট্রিস্টানকেও।বীপরিতার্থক দুটি রুপ যেখানে ডন জুয়ান একের পর এক নারীর সঙ্গ অনুসন্ধান করছে, তেমনি ট্রিস্টান এর মতই সে তেরেজার মধ্যেও ভালোবাসা অনুসন্ধান করছে। সাবিনা তার সাথে টমাসের সম্পর্কে ডন হুয়ান এর ছায়া খুঁজে পেলেও, তেরেজার সাথে তার সম্বর্কে ট্রিস্টানকে স্মরণ করে।
[২২] টলস্টয়: লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০), লিও টলস্টয় নামে ইংরেজীভাষীদের কাছে পরিচিত, রুশ লেখক, যাকে সর্বকালের একজন অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে মনে করা হয়ে থাকে।
[২৩] আনা কারেনিনা, টলস্টয়ের একটি উপন্যাস, যা প্রথম ধারাবাহিক কিস্তি হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল দি রাশিয়ান মেসেঞ্জার শীর্ষক একটি পত্রিকায় ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৭ অবধি।



আপনার মন্তব্য