প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-২৮ ০০:৫৬:৪৭
আসমা সুলতানা:
‘ভালোবাসা’ শব্দটি পৃথিবীর অভিধানের সব থেকে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ এবং বোধকরি সব থেকে ভুলভাবে ব্যাখ্যায়িত একটি শব্দ। এই শব্দটির গভীরতাকে অনেকেই সহজে উপলব্ধি করতে না পারলেও, সবার জীবনে এর উপস্থিতি জানিয়ে দেয় এর গুরুত্ব। যতটা অগভীর ভাবা হয়, হয়তো তার থেকে অনেক বেশী সুগভীর শব্দটি। ভালোবাসার জন্য মানুষ যেমন বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে, তেমনি জীবনের অনেক কিছু করেছে উৎসর্গ। সেই ভালোবাসা যদি হয় শিল্পী যুগলের তবে হয়তো তাতে থাকে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সাধনা। সাধারণ মানুষ সেই অপার্থিব ভালোবাসার অর্থ বুঝতে না পেরে, বাড়াবাড়ি রকমের পাগলামো ভাবতে পারে। পৃথিবীর কোনো বাধাই তাদেরকে আটকাতে পারে না। প্রয়োজন হলে তারা তাদের ভালোবাসার সুউচ্চ সুবর্ণ চূড়াতে আরোহণ করে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাপ দিতে পারে শাশ্বত অন্ধকারে। এমনকি তাদের সেই প্রস্থানও হয় শৈল্পিক। সেই ভালোবাসার স্মৃতি পরিণত হয় এক হৃদয়স্পর্শী গল্পে, পৃথিবীর মানুষের কাছে বিস্ময় হয়ে রয়ে যায়। মহাকালের সময়ের কাছে রয়ে যায় অমর হয়ে। কবি বায়রনের (১৭৮৮ -১৮২৪) কথাটি হয়তো উপযুক্ত হতে পারে আজকের এই প্রবন্ধের সাথে যে “পুরুষের ভালোবাসা তার জীবনের একটি অংশ মাত্র, নারীর ভালোবাসা তার অস্তিত্বের পুরোটা” -- ভালোবাসার খাতিরে কে কতটুকু উজাড় করে দিতে পারবে, সে প্রশ্ন বেশ জটিল ও অসমাধান যোগ্য হলেও, আমার ব্যক্তিগত মতামত; নারীরা সাধারণত নিরাপত্তাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করে থাকে। জিন এবুতার্ন (৬ এপ্রিল ১৮৯৮ - ২৫ জানুয়ারি ১৯২০) ছিলো ব্যতিক্রম সে ক্ষেত্রে এবং বায়রনের কথায় সঠিক। জিন তাঁর সর্বস্ব উজাড় করে ভালোবেসেছিলো, শিল্পী মদিলিয়ানীকে, যাকে সে ছোট্ট করে মদি বলে ডাকতো - ‘আমোরে মদি’।
১৯২০ সালের ২৫ জানুয়ারি। কনকনে শীতের ভোর রাতে, প্যারিসের বুকে তখনও তুষার জমে ছিলো হয়তো, নিদ্রাচ্ছন্ন শহরে, হিমশীতল থমথমে একটা পরিবেশ। মৃত্যুপুরী বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না। কারণ একটি মৃত্যুশোক প্যারিস এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি, আবার আরো একটি মৃত্যুর জন্য চির আমুদে প্যারিস প্রস্তুত ছিলো না সেই রাতে। ভাই আন্দ্রে এবুতার্ন তার আদরের ছোটো বোনটিকে পাহারা দিয়ে রেখেছিলো সারাক্ষণ। জিনকে সে কোলের উপরে হাত রেখে বসে থাকতে দেখে জানালার পাশে। একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টি মেলে। বোনটি তার শান্ত হলেও জেদি স্বভাবের। তাই স্বভাবের কোনো ভিন্নতা লক্ষ্য করেনি ভাই আন্দ্রে সে রাতে। তবুও জানতো বোনের তরুণ প্রেমিক মন, সদ্য স্বামী হারানোর কষ্টকে সামলে নিতে পারবে না খুব সহজেই। আন্দ্রে তাই পাহারা দিয়ে রেখেছিলো বোনকে, কিন্তু শেষ রাতের দিকে তার দু চোখও ক্লান্তিতে বুজে আসে। আন্দ্রে খেয়াল করেনি হয়তো, জিনের চোখে ছিলো অদ্ভুত এক গভীরতা, যেনো সে দেখতে পারছিলো মদির চলে যাওয়ার দৃশ্য। ঘাড়টা একটু বাকিয়ে সে তাকিয়ে আছে অজানা সেই গন্তব্যের দিকে। মদির চিত্রকলার জন্য মডেল দেবার সময় যেভাবে চেয়ারে বা বিছানার পাশে বসে থাকতো, ঠিক সেভাবে সে বসে ছিলো সারা রাত। যে পথে মদি হেঁটে গিয়েছে মাত্র একদিন আগে, জিনও পা বাড়ায় সেই একি পথে। সে আর একা থাকতে পারবে না, সে পারবে না মদিকে ছাড়া বেঁচে থাকতে, সে পারবে না মদি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে। সে চারতলার জানালা দিয়ে আকাশে পাখা মেলে দিলো, অনন্তের দিকে নিঃশব্দে, নিভৃতে। প্যারিসের কোনো মানুষ তার চলে যাওয়াকে একটুও বুঝতে পারলো না। নিদ্রাচ্ছন্ন শহরটি আরো তলিয়ে গেলো নিস্তব্ধ অন্ধকারে। জিন সাথে নিয়ে গেলো তার অভূমিষ্ট আট মাসের শিশুকেও।
দরজায় টোকা দেবার শব্দে আন্দ্রে জেগে যায় ঘুম থেকে, তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দেখে, আঙ্গিনায় পড়ে আছে, বোনের ক্ষতবিক্ষত শরীর। শরীর চিরে বের হয়ে গেছে তার অভূমিষ্ট শিশুটিও। এ দৃশ্য কোনোভাবেই দেখতে দিতে চায়নি তার মাকে। আন্দ্রে বোনের শরীরকে বাড়ীর আঙ্গিনা থেকে সরানো ব্যবস্থা করে। এরপরে পরিবারের সবাই মিলে, মা বাবা ও কাছের অল্প কয়েকজন বন্ধু মিলে তারা, জিনকে সমাধিস্থ করে প্যারিস থেকে দূরে, ছোটো একটা, সমাধিস্থলে; সিমেতিয়ের দো বানইয়ো-তে, খুব নীরবে এবং খুব গোপনে। কেউ যেন জানতে না পারে। আত্মহত্যা ক্যাথলিকদের জন্য মহাপাপ, আরো যদি সেটি ঘটে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়। এবং সেই সন্তান যদি হয় , বিবাহপূর্ব ভালোবাসার ফসল, তাহলে তো সমাজের মানুষের মুখরোচক গল্পের জন্য কোনো উপাদানের অভাব হবে না। জিনের বাবা- মা সারা জীবন তাদের মেয়ের এই নাটকীয়তাকে লুকাতে চেয়েছেন। তারা তাদের মেয়ের ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতে সর্বদাই কুণ্ঠা বোধ করতেন। এমনকি জিনের ভাই আন্দ্রে, যে নিজেও একজন চিত্র শিল্পী, বোনের মৃত্যুর পর আর কোনো দিনও জিনকে নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করেনি। যদিও সে বেঁচে ছিলো বহু কাল। সফল চিত্র শিল্পী হিসেবে সে প্যারিসে কাটিয়ে দিয়েছে বাকিটা জীবন।
জিনের জন্ম প্যারিসে। একই শহরের মোপারনাসতে ভাই আন্দ্রের হাত ধরে সে পা রাখে শিল্পকলার জগতে। সেখানে তার পরিচয় ঘটেছিল সেই সময়কার অনেক চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে। পরবর্তীতে সে ভর্তি হয় আকাদেমি কোলারসি’তে , যেখানে ভাস্কর শানা ওরলফ তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো শিল্পী মদিলিয়ানির সঙ্গে। সেখানে মদি যেতো বিনা পয়সায় মানব শরীরের রেখা চিত্র আঁকতে। খুব অল্পদিনেই , জিন এবং মদি একজন আরেকজনের খুব কাছে চলে আসে। নিজেদের ভেতরটাকে চিনতে তাদের একটুও ভুল হয়নি। তারা দুজনে একসাথে বসবাস করা শুরু করে। তারপরে শুরু হয় নিয়তির নিষ্ঠুরতার অধ্যায়। তাদের একের পর এক পার করতে হয় সেই সব কালো অধ্যায়গুলো, যদিও তারা শেষ রক্ষা করতে পারেনি নিজেদেরকে।
যদিও জিনের আগে মদির জীবনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ নারীদের উপস্থিতি এবং ঘনিষ্ঠতা ঘটেছিল। তারপরেও মদি জিনের প্রতি যেমন তীব্র ভালোবাসা অনুভব করেছিল, তেমন জিন মদিকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছিল। মদির জীবনে নারীর ভালোবাসায় পূর্ণ ছিলো সর্বদা। রুশ কবি আনা আখমাতোভা‘র সঙ্গেও মদির ছিলো সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর সম্পর্ক। মদি আনার অনেক রেখা চিত্র নির্মাণ করেছে তাদের সম্পর্ক চলাকালে।
ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গো (১৮৫৩ - ১৮৯০) এবং ইতালিয়ান শিল্পী আমেদেও মদিলিয়ানী (জুলাই ১২, ১৮৮৪ - জানুয়ারি ২৪, ১৯২০) এর জীবন ও শিল্পকর্মের মধ্যে সাদৃশ্য অনেক খুঁজে পাওয়া যায়। আবার অসাদৃশ্যতাও কম নয়। তাদের মধ্যকার প্রধান যে সাদৃশ্য লক্ষণীয় সেটি হলো, তারা দুজনই মানুষ হিসেবে অসম্ভব সৎ এবং সাহসী। শিশু সুলভ সরলতায় ভরা তাদের মন ও শিল্পকর্ম। তাদের দুজনের শিল্পকর্মই সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে, সহজবোধ্যতার কারণে। অন্যদিকে অমিলের মধ্যে, মানুষ হিসেবে ভিনসেন্ট যেমন অস্থির, অচঞ্চল মদিলিয়ানীও বোহেমিয়ান হলেও তাঁর মধ্যে অদ্ভুত এক স্থিরতা কাজ করতো। ঠিক ভিনসেন্ট এর বিপরীত ; মদির জীবন ছিলো নারী প্রেমে সিক্ত, নারীরা তাকে পেলে লুফে নিতে দ্বিধা করতো না এক ফোটাও, তাঁর ক্যারিশম্যাটিক আচরণের জন্য। তাঁর সৃজনশীলতার খ্যাতি ছিলো চারিদিকে। ভবঘুরে, একরোখা, দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী এই শিল্পী পুরুষটি, নারীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলো তাঁর সমসাময়িক সময়ে। এবং আমরা জানি ভিনসেন্ট এর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটে ছিলো।
মদি ও জিনের এর প্রথম সন্তান ‘জিন মদিলিয়ানি‘র জন্মের পরে, জিন যখন আবারো অন্তঃসত্ত্বা হয়, তার দ্বিতীয় সন্তান সহ, তখন আট মাসের মাথায় মদিকে হারিয়ে জিন যেনো সব কিছু হারিয়ে ফেলে। আর একদিনও সে বেঁচে থাকতে চায়নি মদিকে ছাড়া। এমন ভালোবাসা কোন পুরুষই না প্রত্যাশা করবে একজন নারীর কাছ থেকে!
মদি জিনকে এঁকেছে অসংখ্যবার। মদির চিত্রকলার বিষয়বস্তু মূলত মানুষ, তাদের প্রতিকৃতি। চিত্রকলা ও ভাস্কর্য মদিলিয়ানির প্রিয় মাধ্যম। ভ্যান গো’র মতো মদিলিয়ানি অসম্ভব জনপ্রিয় একজন শিল্পী। তবে মদিলিয়ানির জনপ্রিয়তা ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মিউজিয়ামে বিক্রি হয় তার কাজের হাজার হাজার পোস্ট কার্ড, তার একটাই কারণ, মদিলিয়ানির সহজ সরল উপস্থাপনা। শিল্পকলার জগতে সরলীকরণের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ মদিলিয়ানির কাজ। মদিলিয়ানি তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে, যে চিত্রকর্ম নির্মাণ করতে পেরেছিলেন তার সবগুলোই আজ মাস্টারপিস। তাদের বেশীর ভাগ প্রতিকৃতি, ন্যুড এবং মানব অবয়ব। মদিলিয়ানির প্রতিকৃতি বা অবয়বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো বাঁকানো শরীর বা ঘাড়, অস্বাভাবিক ভাবে লম্বা ঘাড়, রাজহাঁসের মতো, এবং চোখ। মদিলিয়ানি মানুষের চোখকে মনের দরজার মতো ব্যবহার করেছেন, করো চোখ শূন্য কারো বা কালো কারো বা সম্পূর্ণ। মদিলিয়ানি তাঁর সামনে বসা মানুষটিকে ঠিক যেভাবে পড়তে পারতেন তাকে তিনি সেই ভাবেই এঁকেছেন। বলা হয়ে থাকে তিনি যদি কারো ভেতরটা পড়তে পারতেন তবেই তার চোখ আঁকতেন।
মদিলিয়ানির শিল্পকলাতে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। সেই ভালোবাসা একপাক্ষিক। স্থির, অচল, যেমন জিন গভীর ভালোবাসা ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে মদির দিকে। মদি তাঁকে আঁকছে, তাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায় না কোনো চিত্রে। মদিলিয়ানি নিজেকেও চিত্রিত করেছেন। রঙের ব্যবহারেও রয়েছে তাঁর স্বতন্ত্রতা। মূলত ধূসর, মেরুন, বাদামী, কালো, ছাই রঙের ব্যবহার দেখা যায়। পার্থিব রঙের ব্যবহার সেখানে বেশী।
খুব সহজ সরল কম্পোজিশনে করা তাঁর শিল্পকর্মগুলো দেখলে মনে হয় যেন সে জানতো তাঁর জীবনের সময় কম। খুব দ্রুত সে এঁকে গেছে একের পর এক চিত্রকর্ম। জিনও ছিলো শিল্পকলার শিক্ষার্থী। মাত্র ২১ বছর বয়সের জিনের সংক্ষিপ্ত জীবন; তাদের ভালোবাসাটা বেড়ে উঠতে পারেনি শেষ জীবন পর্যন্ত। মদিলিয়ানি শৈশব থেকেই রুগ্ন শরীরের। মায়ের খুব কাছের। মা তাকে অনেক আদরে বড় করেছিলো, মা জানতেন ছেলে বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হবে একদিন। নিয়তির পরিহাসে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হলেও, মদিলিয়ানিকে তাঁর মা অনেক কষ্টে শিল্পী হতে সাহায্যে করেছিলেন শেষ পর্যন্ত।
মদিলিয়ানির চিত্রকলা দেখলে কবি পাবলো নেরুদার প্রেমের কবিতার সাথে মিল খুঁজে পাই আমি। এমন সাধারণ ভাবে অসাধারণ ও গভীর প্রেমের কথা আর কে বলে যেতে পেরেছে ? মদিলিয়ানির চিত্রকলা জাপানি হাইকুর মতো। আট সাট অল্প শব্দে লাইনে, পুরো গল্পটা বলে দেয়া।
যত সহজে মদিলিয়ানি আর জিনের ভালোবাসার কথা বলা যায়, তত সহজ ছিল না তা মোটেও। অনাহারে, অর্ধাহারে কাটিয়েছে মদি। অভুক্ত শিল্পী, উষ্ণতাহীন ঘরে যে দিনের পর দিন কাটিয়েছে, মদ্যপানে আসক্তি, ভালোবাসায় বুদ হয়ে এক প্রেমিক শিল্পীর জীবনের অবসান ঘটে। শৈশব থেকেই মদির টিউবারকিউলাস মেনিনজাইটিস ছিলো। সেটা আরো বাড়িয়ে দেয় তাঁর অনিয়ম ও অবহেলা।
একজন মানুষ জীবনের কাছে কি প্রত্যাশা করে ? একজন নারীই বা কি প্রত্যাশা করে বা একজন শিল্পী? হয়তো অনেকে অনেক কিছু অর্জন করে নেয়, পার্থিব সুখ, শান্তি, সম্পদ ও সফলতা। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ ভালোবাসাকে বেছে নেয় জীবনের গভীর প্রশান্তির খোঁজে। এবং তার জন্য যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে। সে ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য কয়জনের থাকে? অনেকে হয়তো পেয়েও চিনিতে ভুল করে বলে পাওয়া হয় না আর। অনেকে হয়তো পেলেও বুঝে ওঠার আগে, ঘটে যায় অনেক ঘটনা, গড়িয়ে যায় সময়।
এমন সুতীব্র ভালোবাসাকে প্রকৃতি সফল হতে দেয় না। কারণ, সত্যিকারের ভালোবাসাতেই নিহিত আছে সমস্ত সমস্যার সমাধান। পৃথিবী সফল হতে দেয় না এমন ভালোবাসা, কারণ পৃথিবীতে তাহলে অশান্তি বলে কিছু থাকবে না। শুধু তাই নয়, মনে করা হয় মৃত্যুর পরে ভালোবাসার মানুষের সাথে পাড়ি জমাবে শাশ্বত ভালোবাসার রাজ্যে , সেখানেও বাধ সাজে মানুষের নিয়তি। মৃত্যুর পরেও সেই ভালোবাসাকে আপন করতে লেগে যায় আরো এক দশক। সেই নিষ্পাপ, গভীর, সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো মদির মতো এমন একজন প্রেমিক পুরুষের, যার প্রথম প্রেম ছিলো শিল্পকলা। যে আধুনিক শিল্পকলায় দিয়ে গিয়েছেন, শিশু সুলভ সরলতার ছোঁয়া। যার সহজ, সরল, সাবলীল রেখা ছুঁয়ে যায়, প্রেমিক মন। যে প্রেম শিল্পের তরে ও যে প্রেম ভালোবাসার তরে।
জিন নামের এক সুন্দরী তরুণীর ভালোবাসায়, জীবন হয়েছে অমর তাঁর। জিন ছিলো অসম্ভব সুন্দর, ভিতরে ও বাহিরে। তাদের ভালোবাসা কে শাশ্বত করতে, জিন মদিলিয়ানি মারা যাবার পরে আর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারেনি। গর্ভের সন্তানকে নিয়ে , আত্মহত্যা করেছিলেন স্বামী মদির সাথে যোগ দেবেন বলে। সেই শাশ্বত প্রেমের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। এই শিল্পী দম্পতি, দুজন দুজনকে প্রেরণা দিয়ে গেছেন, যে সময়টুকু তারা কাছে ছিলেন।
পৃথিবীতে অল্প সংখ্যক শিল্পী, দরিদ্রতায়, অসুখে, কষ্টে ভুগে মৃত্যু বরণ করেছেন কিন্তু নিজের আত্মা কে বিকিয়ে দেননি। মদিলিয়ানি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। যিনি শিল্পকলাকে করে গেছেন সমৃদ্ধ , ভালোবাসাকে করে গেছেন অমর ও উজ্জ্বল। কবি বায়রনের কথা কে অস্বীকার করবার মতো শক্তি হয়তো শিল্পী ও প্রেমিকা হিসেবে হবে না আমার। শিল্পী বা প্রেমিক হারিয়ে গেলেও ভালোবাসায় ভরা শিল্পকর্মগুলো রয়ে যায়, যা চিরকাল সাক্ষ্য বহন করে সেই পাগল করা ভালোবাসার কাহিনীগুলোকে।
জিনের মৃত্যুর একদশক পরে তাঁর দেহকে স্থানান্তরিত করা হয়, পের লাশেজ সমাধিক্ষেত্রে। মদির সমাধির পাশে জিনকে শুইয়ে দেয়া হয় চিরকালের মতো। আর তাঁর সমাধি ফলকে খোদাই করে দেয়া হয় - “চূড়ান্ত আত্মবিসর্জনে যে একনিষ্ঠ সঙ্গী”।
আপনার মন্তব্য