বিধ্বংসী ভালোবাসা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৬-০৩ ০৩:১০:১৪

 আপডেট: ২০১৬-০৬-০৩ ১৬:৪৬:১৪

আসমা সুলতানা:

জন্মদিন, মার্ক শাগাল, ১৯১৫, কার্ডবোর্ডে তৈলচিত্র
“শুধুমাত্র ভালোবাসাতেই আমার আগ্রহ, এবং আমি সেই সব বিষয়গুলোর সংস্পর্শে আসতে পছন্দ করি যাদের সৃষ্টি ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই”- রুশ চিত্রশিল্পী মার্ক শাগালের উক্তি। পৃথিবীর তাবৎ শিল্পীদের মনের কথাই হয়তো এটা। অন্তত আমার মনের কথা তো বটেই। ভালোবাসা ছাড়া সৃষ্টি কি সম্ভব?  কখনই সম্ভব নয়। শিল্পীদের ভালোবাসার প্রকৃতি যদিও বেশ অদ্ভুত হয়ে থাকে। তারা সব কিছুকে ভালোবাসাতে পারে, আবার হয়তো বা কোনো কিছুকেই ভালোবাসে না, কিছুটা হলেও নার্সিসিজম কাজ করে এমন ভাবাটাও অমূলক নয়। এমন এক অদ্ভুত টানাপোড়নের মধ্যে হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা যন্ত্রণা, হতাশা, কষ্ট বা না পাবার বেদনায় তিলে তিলে তারা সৃষ্টি করে যায় এক একটি শিল্পকর্ম, যেনো অদৃশ্য কোনো মাতৃ জঠরে জন্ম নিচ্ছে নিত্য নতুন শিশু।শিল্পীরা চিরপ্রেমিক, তারা প্রেমে বুদ হয় প্রতিনিয়ত, সে প্রেম হতে পারে প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য এমনকি শিল্পের জন্যও। শিল্পীদের ভালোবাসার বা প্রেমের সেই রহস্যময় জগতটি কেমন, আমাদের হয়তো অনেকটাই অজানা। কিন্তু কোনো শিল্পীকে এবং তার শিল্পকর্মকে জানতে বা বুঝতে গেলে, তার জীবন সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের জানতে হবে। ভালোবাসা ব্যতীত কোনো শিল্পীই, শিল্পী হয়ে উঠতে পারে না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে শিল্পী সত্তাকে তার প্রেমিক সত্তা থেকে আলাদা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

আত্মপ্রতিকৃতি, ভিনসেন্টভ্যানগো (১৮৫৩-১৮৯০) ১৮৮৭, বোর্ডে তৈলচিত্র
 ১৮৮৮ সালের ডিসেম্বরের ২৩ তারিখের এক শীতের রাত। দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি শহর আর্লস; আমরা সেই রাতের কথা জানি যখন, ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গো একটি কাগজের মধ্যে কিছু একটা জাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তাঁর পায়ের ধাক্কায় পাথার ছিটকে পড়ছে এদিকে সেদিকে, তাঁর টালমাটাল চলার ভঙ্গি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে সে প্রকৃতিস্থ নয়। অন্ধকারের ভেতরেও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তাঁর কানের পাশ দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। সে তার গন্তব্যে থেমে যায় এবং একটি দরজায় ধাক্কা দেয়। চিরপরিচিত সে দরজা এবং পরিচিত এক রমণী দরজা খুলে দিয়ে খুব চেনা ভঙ্গিতে তাকে ভেতরে আসতে বলে, শিল্পী ভিনসেন্ট সেই রমণীর হাতে তাঁর কাগজের প্যাকেট টি গুজে দিয়ে দ্রুত পায়ে ফিরে যায়। অতঃপর আকাশে বাতাসে নারী কণ্ঠের চিৎকার ভেসে আসে ...

কানে ব্যান্ডেজ বাধা আত্মপ্রতিকৃতি, ভিনসেন্ট ভ্যান গো, ১৮৮৯
ভিনসেন্ট তাঁর কানের খানিকটা অংশ কেটে সেই পতিতাকে সে রাতে উপহার দিয়ে আসেন, কিন্তু ভিনসেন্ট কেনো তাঁর নিজের কান কাটতে যাবেন?  আজো আমাদের কাছে অজানা। সবাই ভালোবাসার রমণীকে ফুল উপহার দেয়, দেয় মূল্যবান কোনো বস্তু, ভিনসেন্ট কেনো নিজের কান ছিঁড়ে দিতে যাবেন?  কে জানে?  সে ঘটনার কোনো সুস্পষ্ট সাক্ষী বা তথ্য আমাদের জানা নেই। মনে করা হয় ভিনসেন্ট ও শিল্পী গঁগ্যা দুজনই খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন বলে কেউ কোনো দিনও সে বিষয়ে মুখ খোলেননি। অনেকের ধারণা, হয়তো শিল্পী বন্ধু পল গগ্যাঁ’র সাথে তার তর্কবিতর্কে বা হাতাহাতির ফলে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিলো যে ভিনসেন্ট তাঁর কানটাকে বাঁচাতে পারেনি, অথবা হিংসা বশত নিজেই নিজের কান কেটে দিয়ে এসেছিলো সেই পতিতাকে যাকে সে পেতে চেয়েছিলো খুব আপন করে (?)। অথবা তাঁর অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণাকে ভুলতে গিয়ে, সে তাঁর শারীরিক কষ্টকে বাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলো শতগুণে। ভিনসেন্ট একর পর এক আত্মঘাতি প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রত্যাখ্যানের বেদনাগুলো কে ভুলতে চেয়েছিলের তার জীবদ্দশায়। যদিও সেকারণেই ১৮৮৯ সালের শুরুর দিকে আমরা উপহার পায় অসাধারণ এক শিল্পকর্ম; যার শিরোনাম ছিলো - “ কানে ব্যান্ডেজ বাধা আত্মপ্রতিকৃতি”। ভিনসেন্ট ভ্যান গো আরো একবার পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন, কষ্ট ছাড়া সৃষ্টি হয় না।

শিল্পী পল গগ্যাঁ’র আঁকা ভিনসেন্ট ভ্যান গো এর প্রতিকৃতি - ‘সূর্যমুখীর শিল্পী’, ১৮৮৮
আরো একটু অতীতের দিকে ফিরে গেলে দেখা যাবে যে, ১৮৭৫ সালে ভিনসেন্ট যখন তার চাচার লন্ডনের গুপিল গ্যালারিতে কর্মরত ছিলেন একজন সাধারণ শিল্পকর্ম বিক্রেতা হিসেবে ; তখন তিনি সেখানে উরসুলা লয়ার নামের ৫৮ বছরের বেশী বয়স্ক এক বিধবা মহিলার বাসায় লজিং থাকতেন। তিনি তাঁর ১৯ বছর বয়সি মেয়ের সাথে একটি বাচ্চাদের স্কুল পরিচালনা করতেন নেই বাড়ীতেই। ভিনসেন্ট সেই সময় উরসুলা লয়ারের কন্যা ‘ইউহেনিয়া লয়ার’র অনুরাগ প্রার্থী হন। ভিনসেন্ট জানতো না যে গোপনে ইতিমধ্যে অন্যকারো বাগদত্তা হয়ে আছে, বা জানলেও ভিনসেন্টের অদম্য আগ্রহ সে চাপা দিতে না পেরে, উরসুলা কন্যাকে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেন। কিন্তু হায় ! তাকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করা হয়না, করা হয় অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে, অপমানও করা হয় নির্মম ভাবে। যদিও ভিনসেন্ট ইউহেনিয়া কে অনুরোধ করে সেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে তাঁর জীবনে চলে আসতে, কিন্তু তাতেও সে রাজি না হলে, ভগ্নহৃদয় ভিনসেন্ট মারাত্মক ভাবে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে ভিনসেন্ট নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে নেন, একা হয়ে পড়েন। কোনো এক পর্যায়ে তিনি ভাই থিওকে চিঠিতে লেখেন ‘আমি হয়তো সারা জীবন চিরকুমার রয়ে যাবো ’।

১৮৭৩ সালে ভিনসেন্টের আঁকা রেখাচিত্রে লন্ডন
নারীজাতি শক্ত পুরুষের নিকট যতটা নমনীয় আচরণ করতে পারে, ভিনসেন্টের মতো শিশুর মতো সরল একজন পুরুষের নিকট তারা ততটাই নির্মম  হয়ে উঠতে পারে।

ইউহেনিয়া লয়ার
যদিও ছোটো ভাই থিও কে ভিনসেন্ট সব সময় চিঠি লিখতো কিন্তু, তাঁর ভালোবাসা বা প্রণয় বিষয়ে সে খুব কম উল্লেখ করেছে। ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে, সে থিও কে লেখে “আমি একজন নারীকে চলে যেতে দিয়েছি, সে অন্যকে বিয়ে করেছে। আমি তার কথা ভোলার জন্য অনেক দূরে চলে এসেছি, ভুলতে পারিনি। বিধ্বংসী।”--- কথা গুলো থিওকে সে বলে ছিলো ক্যারোলাইনকে উদ্দেশ্য করে।

ভ্যান গো এর অনুজ থিও ভ্যান গো (১৮৫৭-১৮৯১)
যদিও মনে করা হয় ইউহেনিয়া ভিনসেন্টের প্রথম প্রেম, তবে মতান্তরে ভ্যান গো এর আগেও একজন ১৯ বছর বয়সি তরুণীর প্রেমে পড়ে বলে মনে করা হয়। তার নাম ক্যারোলাইন হানবেক। নেদারল্যান্ডের রিজউইকে তাদের সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাতে ভিনসেন্ট এই তরুণীর প্রেমে পড়ে যান- যাকে তিনি নাম দেন ‘সব থেকে কোমল বুনোফুল’ বলে। কিন্তু যখন জানতে পারেন তাঁরই এক জ্ঞাতিভাইয়ের সে বাগদত্তা তখন, ভিনসেন্ট তার অনুজ থিও কে বলেছিলো “আমি যদি কোনো ভালো রমণী খুঁজে না পায়, তবে খারাপই সই’- আমি একা থাকতে পারবো না, কোনো পতিতা হলেও চলবে”। যদিও ভিনসেন্ট সব সময় শারীরিক চাহিদা থেকে তাড়িত হবার চেয়ে, মানসিক আশ্রয় খুঁজতেন, খুঁজতেন সমমনা কোনো নারীকে, তার চিন্তা চেতনার সঙ্গী করতে। ক্যারোলাইনের কথা ভিনসেন্ট তাঁর চিঠিতে নানা স্থানে উল্লেখ করেছেন। এমনকি তিনি ক্যারোলাইন এবং তার স্বামী উইলেমকেও চিঠি লিখতেন। থিওকে কোনো একটি চিঠিতে ভ্যান গো উল্লেখ করেছিলেন, অল্প বয়সের সেই প্রেম ও প্রত্যাখ্যানের কথা, সেই প্রত্যাখ্যানের বেদনা যে বৃথা যায়নি সেটাও তিনি নিশ্চিত করেছেন। ভিনসেন্টের সাহসী সব পদক্ষেপ এবং জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েও তিনি তার সৃষ্টিকে রেখেছিলেন সচল, জীবনের সব ব্যর্থতা কে পিছনে ফেলে তিনি শিল্পকে আপন করে নিয়েছিলেন।

স্টারি নাইট, ভিনসেন্ট ভ্যান গো, ১৮৮৯,  মোমা , আমেরিকা, আলোকচিত্র: আসমা সুলতানা
ইউহেনিয়া লয়ারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এবং মানসিকভাবে বিভ্রান্ত ভবিষ্যৎ শিল্পী যখন নেদারল্যান্ডে ফিরে যান তখন, তার জ্ঞাতিবোন কি ভসে’র প্রেমে পড়েন আবার। ১৮৮১ সালের আগস্ট মাসে কি ভসে সদ্য বিধবা হয়ে ঘরে ফিরেছেন তার পুত্রকে নিয়ে। এবং ভিনসেন্ট প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় জীবনে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তিনি তাঁর জ্ঞাতিবোন কি ভসে কে প্রেম নিবেদন করলেন এই বলে যে; ‘আমি তোমাকে ততটুকুই ভালোবাসি যতটুকু নিজেকে’-‘তুমি কি আমাকে বিয়ে করার ঝুঁকি নেবে’? স্বাভাবিক ভাবেই পারিবারিকভাবে বাধা আসে। কারণ, উনবিংশ শতাব্দীতে নেদারল্যান্ডে চাচাতো-মামাতো ভাই বোনের মধ্য বৈবাহিক সম্পর্ক হওয়াকে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হতো। কি এর বাবা তার মেয়ের সাথে ভিনসেন্ট কে দেখা করতে না দেয়ায়, তাঁর ধারণা হলো যে, মেয়ের বিরুদ্ধে তিনি কাজটা করছেন বলে ভিনসেন্ট জোর করে, কি এর সাথে দেখা করতে চায় একদিন এবং একটি জ্বলন্ত মোমবাতি তে হাত রেখে বলে “ আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দাও, তা না হলে আমি আমার হাত সরাবো না এই আগুন থেকে ”।

ভিনসেন্টের জ্ঞাতিবোন কি ভসে ও তার পুত্র, ১৮৮০
কিন্তু হায়, নিয়তি যখন ঠিক করে রেখেছে তাঁর ভাগ্যে ভালোবাসা জুটবে না, কোনোদিনও। নিয়তিকে কে খণ্ডাতে পারে?  কি ভসে আবারো নির্মমভাবে এই ক্ষেপাটে শিল্পীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। এবং চিৎকার করে বলেছিলো ‘না , নাহ, কখনই না !’
শিল্পীভ্যান গো কে কোনো নারী সঠিকভাবে চিনতে পারেনি সেদিন। কারণ সময়ের আগে জন্ম নেয়া প্রতিভাধর মানুষকে বোঝার ক্ষমতা, তার সমসাময়িকদের মধ্যে থাকে না। তবে আর ভিনসেন্টের মৃত্যুর শত বছর পরেও তিনি হয়েছেন শত শত রমণীর প্রেরণা ও ভালোবাসার কেন্দ্র। সেই অর্জন গুটি কয়েক সাধারণ রমণীর ভালোবাসা পাবার থেকে শত গুনে বেশী।

সূর্যমুখী, ভিনসেন্ট ভ্যান গো, ১৮৮৮
ভিনসেন্টকে মনে করা হতো, শিশু সুলভ একজন মানুষ, যে সমাজের বাকি দশজন মানুষের মতো চিন্তা করতে জানতো না, যার কোনো বৈষয়িক জ্ঞান ছিলো না, লোভ কিংবা লালসা কোনোটাই তাঁর ছিলো না। সে মানুষকে চিনতে বা বুঝতে পারতো না সঠিক ভাবে। থিও কে সে একবার চিঠিতে লিখেছিলো যে “সম্পর্ক তো শুধু নেবার জন্য নয় দেবার জন্যেও”। ভিনসেন্ট সব সময় সব ক্ষেত্রে নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর সাথে কয়েকজন পেশাদার পতিতার সম্পর্কের কথাও জানা যায়। তাদের মধ্যে সিন হুরনিকের নাম সব থেকে পরিচিত। ১৮৮১-১৮৮৩ সালের মধ্যেকার ঘটনা। ভিনসেন্ট ভ্যান গো এর অনেক শিল্পকর্মে আমরা সিন হুরনিক কে দেখতে পাই। তিনি তার কাজের মডেল হিসেবে তাকে ব্যবহার করেছেন। সিন হুরনিক তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলো, এক পর্যায়ে ভিনসেন্ট সিন হুরনিক এর সাথে এক সাথে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে সিন হুরনিক এর একটি পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে এবং আমরা সেই শিশুটিকেও ভিনসেন্টের কাজে দেখতে পাই। পাগলাটে শিল্পী পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েও  সেই শিশু এবং তার পাঁচ বছরের একটি বোনসহই সিনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, অবশেষে ভাই থিও এর অনুরোধে সে সিন হুরনিককে পরিত্যাগ করে। এর সাথে অবসান হয় ভিনসেন্টের একমাত্র সংক্ষিপ্ত সংসার জীবনের।“ হ্যাঁ আমি একটা বেশ্যা ! - আমার সাথে জীবন কাটানো আর নদীতে ঝাপ দেয়া একি কথা।” সিন হুরনিক বলেছিলো ভিনসেন্টকে।

ভিনসেন্টের আঁকা রেখা চিত্র, ‘দুঃখ’ সিন হুরনিক (১৮৫০-১৯০৪)তিনি মডেল হিসেবে ব্যাবহার করেছেন, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, নিউ ইয়র্ক, আলোকচিত্র : আসমা সুলতানা
ধীরে ধীরে ভিনসেন্ট নিজ ভাগ্যের মানচিত্রটা পড়তে পেরে, মেনে নিতে বাধ্য হন যে নারী জাতির মন যখন ঈশ্বরও বুঝতে পারেননি তখন বৃথা চেষ্টা না করে তিনি মনোযোগ দিতে শুরু করেন পড়াশুনা ও শিল্পচর্চায়। যাযাবরের মতো ঘুরে দেখতে থাকেন চারপাশের জগতটাকে। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেন প্রকৃতির কাছে। এবং শিল্পের কাছেও আত্মসমর্পণ করেন তিনি। অতঃপর মাত্র দশ বছরের অবিরাম চেষ্টায় তিনি নিজেকে বিশ্বের প্রথম সারির শিল্পীদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তাঁর সৃষ্ট ‘সূর্যমুখী’ বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় শিল্পকর্ম  বলে বিবেচিত আজকের দিনে।

ভিনসেন্ট এর আঁকা তাঁর মায়ের প্রতিকৃতি, ১৮৮৮, ক্যানভানে তৈলচিত্র
শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গো কেনো পাগলের মতো রমণীদের ভালোবাসা পাবার জন্য ছুটেছেন? কেনইবা তিনি হাহাকার করতেন, কোমলমতি কোনো নারীর স্পর্শের জন্য। খুব সংক্ষিপ্ত করে বললে বলতে হবে, শৈশব থেকে ভিনসেন্ট ছিলেন মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত। ভিনসেন্ট এর জন্মের ঠিক এক বছর আগে তাঁর এক ভাইয়ের জন্ম হয়েছিলো এবং সে শিশু অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তার নামও ছিলো ভিনসেন্ট। এ কথা জানার পর থেকেই ভিনসেন্ট নিজেকে, মনে মনে দায়ী করতেন সে ঘটনার জন্য। শুধু তাই নয়, ভিনসেন্ট তাঁর মায়ের কাছ থেকে কোনো স্নেহ বা ভালোবাসা না পেয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসেন। এবং আমৃত্যু তিনি একটি কথাই বোঝার চেষ্টা করেন সেটা হলো, কেনো তাঁর মা, তাঁর শিল্পকর্মকে ‘দুঃসহনীয়’ বলেছিলেন এবং কোনোদিনও কোনো প্রশংসা করেননি। ভিনসেন্ট ভ্যান গো এর সাথে তাঁর মায়ের সম্পর্কের দূরত্ব ছিলো সারাটি জীবন; তাই ভিনসেন্ট রমণীর ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ, আদর পাবার জন্য ব্যকুল ছিলেন। ভিনসেন্ট এর আয়ু মাত্র ৩৭ বছর হলে কি হবে, তাঁর মা তিন পুত্র সন্তানের অকাল মৃত্যুর পরেও দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন।

জোয়ানা ভ্যান গো (১৮৬২-১৯২৫)এবং তার শিশু পুত্র উইলিয়াম
 যে নারীটির অবদানের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সে হলো - জোয়ানা ভ্যান গো। ভিনসেন্টের ছোটো ভাই থিও ভ্যান গো এর স্ত্রী ও সন্তানের মা। জোয়ানার সঙ্গে ভিনসেন্টে এর সম্পর্কের ব্যাপ্তি খুব সংক্ষিপ্ত কালের। কিন্তু এর স্থায়িত্ব ছিল আজীবন। জোয়ানা যদিও ছিলেন তাঁর ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী, তবুও ভিনসেন্টের সাথে ছিলো তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। এক পর্যায়ে জোয়ানাই নেন ভিনসেন্টে এর মায়ের স্থান, বোনের স্থান বা সহধর্মিণীর স্থান। জোয়ানা তার শিশু পুত্রকে বুকে নিয়ে, ভিনসেন্টের শিল্পকর্ম আকড়ে ধরে, থিও ও ভিনসেন্টের চিঠিপত্রগুলোকে আগলে রেখে সামনে এগিয়ে গেছেন এবং ভিনসেন্টের মৃত্যুর ১৬ বছর পরেও হলে তাকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেই তবে ক্ষান্ত হয়েছেন। যে সব রমণীরা ভিনসেন্টে ফিরিয়ে দিয়ে নারী জাতির কলঙ্ক হয়ে রয়ে গিয়েছিলো, জোয়ানা এক হাতে সেই দাগ মুছে দিয়েছিলেন। আর শিল্পকলার জগতের আকাশে আমাদের উপহার দিয়েছেন একটা উজ্জ্বলতম নক্ষত্র।

তারপরেও ভালোবাসা বেঁচে থাকে। শিল্পীরা প্রেমে পড়ে, সৃষ্টি করে অনবদ্য সব সৃষ্টিকর্ম। মানব বা মানবীর প্রতি প্রেম শিল্পীর জীবনকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেও সৃষ্টির প্রশ্নে ও সৃজনশীল চর্চায় সে থাকে অনঢ় এবং অবিচল। আত্মসমর্পণে শিল্পী নিজেকে ভাসিয়ে দেয়না সমাজ সংসারের চিরয়াতি সংস্কারের মাঝে। সে ভেসে চলে ভিন্ন স্রোতে। একা। বিচ্ছিন্নভাবে। তার চলার সঙ্গী তাঁর হৃদয় মাঝে বয়ে চলা ভালোবাসার ঝর্ণাধারা। ভালোবাসা ও প্রেমই তার সৃষ্টিশীলতার চালিকা শক্তি। ভিনসেন্ট ভ্যান গো যেমনটি বলেছিলেন - “ অনেক কিছুকে একসঙ্গে ভালোবাসা ভালো, ভালোবাসার মধ্যেই শক্তি লুকিয়ে থাকে, যে বেশী ভালোবাসতে জানে সে বেশী পরিশ্রম করতে পারে এবং বেশী অর্জন করতে পারে এবং ভালোবাসায় যে কাজ করা হয় তা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ’’।

রণের উপরে নক্ষত্র রাত, ১৮৮৮, ক্যানভাসে তৈলচিত্র
(চলবে...)

আপনার মন্তব্য