জীবনানন্দ: বিপন্ন বিস্ময়ে ভরা এক নির্জন দ্বীপ

 প্রকাশিত: ২০১৮-১০-২২ ১৪:৪৯:৪৯

 আপডেট: ২০১৮-১০-২২ ১৭:৫২:১২

আলমগীর শাহরিয়ার:

প্রেমের মঞ্জিলে মানুষ একটু দেরিতেই পৌঁছায়।

আমারও তাই হলো। অগ্রজ কবি লেখক শোয়াইব জিবরান থেকে ধার করে বলি, "কেবলই দিরং হয়ে যায়।" হায়, বেশ দিরং (দেরি) করেই অবশেষে সাহিত্যে প্রথম প্রেম জীবনানন্দ দাশের দ্যাশ, ধানসিঁড়ি ও সন্ধ্যা নদীর দেশ বরিশাল গিয়েছিলাম গতবছর। ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। আমাদের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিশাল বহর। পরদিন বরিশালে বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।

সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়েছে। রাতের নির্জন হিমাকাশে একখান উজ্জ্বল চাঁদ। চারপাশে বিশাল মেঘনার বিস্তৃত জলরাশি। স্বচ্ছ জলে ঢেউয়ের তালে চাঁদের আলোর এক অপূর্ব ঝিকিমিকি খেলা। নিশাচর মাছধরা নৌকার আনাগোনা। আর দূর, ওই দূরে কোথাও দেখছিলাম মিটিমিটি আলোতে নিশুতি রাতের গ্রাম গঞ্জ। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ও শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম গল্প ও খাওয়া দাওয়া শেষে নিজ নিজ কেবিনে ঘুমিয়ে আছেন। আমাকে আলী ইমাম ভাই উনার সঙ্গেই থাকতে বললেন। উনার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ নানা প্রসঙ্গে গল্প করলাম। ঊনসত্তরের উত্থাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উনার সক্রিয় ছাত্রলীগের রাজনীতি, পরবর্তীতে সাহিত্য জগতে নিরবচ্ছিন্ন বিচরণ- এসবই ছিল গল্পের সিংহভাগ জুড়ে।
জীবনানন্দকে ঘিরে আমার বাড়তি উচ্ছ্বাস উনার চোখ এড়াল না। সাহিত্য ও চাতুর্যময় বৈষয়িক বাস্তব জীবনের ফারাক কেমন-জীবন থেকে নেওয়া গল্পে বললেন। আর ঠিক হলো বরিশাল প্রোগ্রাম শেষ করে আমরা প্রথম সুযোগেই জীবনানন্দের বাড়ি দেখতে যাব। উনার একটু ঘুম ধরলে পরে আমি বিছানা ছেড়ে লঞ্চের কেবিনের এক চিলতে বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে, হাতে এক কাপ ধোঁয়া উড়া গরম চা নিয়ে, সঙ্গীতের সুরমুর্ছনায় এই শীত শীত রাতে পূর্ণিমার আলোয় দেখতে লাগলাম---পৃথিবী ভীষণ সুন্দর। মনে পড়ল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের ভূমিকায় পড়েছিলাম, "Beauty that vanishes; beauty that passes away; However rare - rare it be."

জলের দেশের মানুষ আমি। নগরীর চেনা কোলাহল, ভিড় বাট্টা, বিরামহীন ইঁদুর দৌড়, ক্লেদাক্ত জীবন ভুলে শীতনিশীথে এমন আনমন প্রকৃতির সুনিবিড় সান্নিধ্যে কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়ছিলাম। আর ভাবছিলাম সম্মুখে যে সৌন্দর্য প্রতিমুহূর্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এ তো দুর্লভই, এ তো ক্ষয়িষ্ণু সুন্দর জীবনের সমার্থক। কোথায় যায় এ জল জীবনের ধারা? কোন অনন্তে যেয়ে মিশে শেষে?

ভোরের আলোয় বরিশাল পৌঁছে আমরা বরিশাল সার্কিট হাউজে গেলাম। ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুলে দুপুর পর্যন্ত আমাদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান চলল। তারপর ফের সার্কিট হাউজে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই আমি উঠে গেলাম। আলী ইমাম ভাই টের পেলেন আমার ভেতরের অস্থিরতা। তিনিও উঠে বললেন, চলো যাই। রিক্সায় করে আমরা চললাম বগুড়া রোডে অবস্থিত জীবনানন্দ দাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জীবনানন্দ দাশের বাড়ির অনতিদূরে সওদাপাতির দোকানের মানুষজন চেনে না কবির বাড়ি। চেনে পাশেই একটা ক্লিনিক আছে তার নাম। এরকমই হয়। মফস্বল শহরের বাড়ি। জীবনানন্দ বা তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশের জ্ঞাতি গোষ্ঠীর কেউ আর এখানে নেই। দেশভাগের পরের বছর ১৯৪৮-এ জীবনানন্দ দাশ স্থায়ীভাবে বরিশাল ছেড়ে কলকাতা চলে যান। বাড়ির ভেতর দুই তিনিটা পরিবারের বাস। বাড়ির আয়তন পরিসর দেখলে বোঝা যায় এক সময় এখানে জীবনের, ভাবনার খানিক অবসর ছিল, সজীব সপ্রাণ প্রকৃতি আর দেখবার মত বিশাল আকাশ ছিল। জীবনানন্দের স্মৃতিকথা থেকে বলা যেতে পারে, “চারদিকে শীতের রাত তখন নিথর, নিস্তব্ধ; আমাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে নারিকেলবীথির ভিতর থেকে বাজকুড়ুল পাখি ডাকতো, প্রহরে প্রহরে সেই পাখি দুটো---বরিশালের শীতের শিয়রে অনন্ত অন্ধকারে দেবযানী আত্মাদের সঙ্গে।”

এখানেই এই বাড়িতে এক হাতে রান্নাঘরের খুন্তি অন্য হাতে কলম নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন ‘আদর্শ ছেলে’ খ্যাত কবিতার কবি কলকাতা বেথুন স্কুলে পড়ুয়া জীবনানন্দের মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ। আর চারপাশের সুনিবিড় প্রাণ প্রকৃতি দেখে প্রতিনিয়ত উদ্দীপ্ত হয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। না, আজ তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবু আমরা ঘোরলাগা তমসায় স্মৃতির জমিন জুড়ে ঘুরি। খুঁজে ফিরি কবিকে। স্মৃতিকে। যে কবি পরজন্মেও এই ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে এই বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। হয়তো মানুষ নয়, শঙ্খচিল শালিকের বেশে; ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন কাঁঠাল-ছায়ায়।

বাড়িতে একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলি যিনি স্কুলজীবনে বিপ্লবী সিরাজ শিকদারের সহপাঠী ছিলেন বলে জানালেন। কথা বলে বুঝতে পারি সেই কবে দেশ ছেড়ে যাওয়া কবির স্মৃতির প্রতি তাদের দায়িত্বশীল হবার কিছু অবশিষ্ট ছিল না, এখনও নেই। যেখানে খোদ রাষ্ট্র উদাসীন। জীবনানন্দের সঙ্গে তুলনারহিত এমন অনেক কবির স্মৃতিঘেরা বাড়ি উত্তর প্রজন্মের জন্য ইউরোপে সুরক্ষিত, যতনে সংরক্ষিত দর্শনীয় স্থান। কিন্তু জীবনানন্দের দুর্ভাগ্য---মহার্ঘ্য শিল্পমূল্য উদাসীন দেশে তিনি জন্মেছিলেন। বাড়ির পাশে জীবনানন্দের নামে দেখলাম একটা পাঠাগার। এই যা। বাড়ির একটু ভেতরে ঝোপঝাড় আর ডোবার মত একটু জায়গায় যেয়ে কিছুক্ষণ উদাসীন দৃষ্টি মেলে তাকাই আমরা। বাড়িময় ঘুরে ফিরে একরাশ মুগ্ধতা নয়, নিশ্চিহ্ন করে ফেলা স্মৃতির বিরান বসতি, ভূমি দেখে বিক্ষুব্ধ হতাশ হৃদয়ে ফিরি। সন্ধ্যায় ব্রজমোহন কলেজে বরিশাল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পাঠচক্র আয়োজিত এক আলোচনায় যোগ দিতে ফের এই রোড হয়ে যাবার সময় সায়ীদ স্যারও আরেক দফা বাড়িটি দেখতে মাইক্রো থেকে নামেন। কিন্তু কবির অনাদৃত জীবনের মত অবহেলিত বিস্মৃত ভূমিতে কালের ক্ষয়িষ্ণু ধুলো, দেয়াল, ঘাস, কিছু অন্য ঘর বসতি ছাড়া কিছুই যে দেখবার নেই। নেই সেই ডাহুক, মাছরাঙা, দোয়েল, লক্ষ্মীপেঁচা পাখি, শালিকের ভিড়।

রবীন্দ্রোত্তর বাঙলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র যুগস্রষ্টা এক কবি জীবনানন্দ দাশ। কবিযশ প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিককালে যার কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘চিত্ররূপময়’ কবিতা, যার দিকে ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে’। সত্যিই এই কবির দিকে জীবন ঘনিষ্ঠ প্রেমাতুর চোখে তাকিয়ে থাকা যায়। ক্লান্তি আসে না। জীবনানন্দ আমার কাছে মহাকালের সমুদ্রে এক অক্ষয় নির্জন দ্বীপ। ক্লান্ত, ক্লিষ্ট জীবনে সে দ্বীপ ভ্রমণে যতবার যাই অফুরান মুগ্ধতা আমাকে কেবলই বিহ্বল করে। যেভাবে বিহ্বল করত শৈশবে গোল্লাছুট খেলা শেষে নির্জন খড়ের মাঠ পউষ সন্ধ্যায়।

আপনার মন্তব্য