ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ১০

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৬ ১৩:৪৫:০৮

 আপডেট: ২০১৬-০২-১৬ ২৩:১৮:৫৭

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২৮
অধীরের  সাহস আর অভিজ্ঞতা  বলছে  রাতটা পার হলে কোন একটা ডাঙ্গা দরকার। জলে এখন বেশি বিপদ। মনে মনে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে নেত্রকোনা হাসপাতালেই যাবে। নদীর ঘাট থেকে হাসপাতাল কাছেই। এখান থেকে নেত্রকোনা খুব বেশি দূর নয়।   নিয়তি মায়ের শরীরও ঠিক নেই। ডাক্তার দেখানোর সুযোগে কয়েক ঘণ্টা হাসপাতালে থাকা যাবে। খোঁজ খবর নিয়ে পরে যা করার করা যাবে। এখন সঙ্গের নৌকাগুলোও আর কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে না। অধীরও আর এই অঞ্চলের কাছাকাছি থাকার সাহস পাচ্ছে না। মৈত্যা আর হানিফকে বৈঠা দিয়ে দিবাকরের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলো। নিয়তি শোয়া বসার মধ্যেই আছে। কথা বলছে না খুব একটা। ঘন ঘন প্রস্রাবের উপসর্গ হয়েছে। মাঝে মাঝেই তার প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে হচ্ছে। নৌকার সামনের দিকটায় কেউ তাই যাচ্ছে না। দিবাকরকে  নিজের পরিকল্পনা শুনিয়ে সে নিজেও একটা বৈঠা নিয়ে ছেলেদের দ্রুত হওয়ার নির্দেশও দিল। মরিয়া অধীর মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করে চলতে লাগলো। অসুস্থ পোয়াতি নিয়ে যাওয়ার কারণে যদি কেউ তাদের হত্যাও করে তা হলে বুঝবো যে দুনিয়া খারাপ মানুষের হাতে চলে গেছে। সেখানে আমরা বাঁচি কেমনে!

মগরা নদীতে পড়তে পড়তে কিছুটা বেলা হয়ে গেল। রাতে না পড়ে ভালই হয়েছে। বেলা ১০টার মধ্যে তারা হাসপাতালের ঘাটে নৌকা  ভিড়িয়ে দিল। পাশাপাশি খান চার পাঁচেক নৌকাও আছে। এখন দিবাকর আলাউদ্দিন ব্যাপারির কল্পিত খোলসে ঢুকে গেল। নিয়তি ঢুকে গেল ময়না বিবির খোলসে। সঙ্গে পরে নিল সেই মুক্তাগাছা থেকে আনা বোরখাটাও।  বাচ্চা দুটোকে চিড়ামুড়িগুড় দিয়ে হানিফের সঙ্গে থাকতে বলা হলো। হানিফকে তাদের পছন্দ। বড়শি দিয়ে নদীতে মাছ ধরার কথা আছে। তাতে তারা খুব খুশি। নৌকাজীবী অধীর অনেকদিন আগে থেকেই কলিমুদ্দি হয়ে আছে। দিবাকর নিয়তি আর অধীর হাসপাতালে গেল। অধীর এর আগেও বার কয়েক হাসপাতালে এসেছে। কিন্তু এবার এসে সে খুব অবাক হলো। মহকুমার একমাত্র সরকারি হাসপাতাল । অথচ বেশি ভিড় নেই। ফাঁকা ফাঁকা হাসপাতাল। আউটডোরে কিছু সময়  অপেক্ষার পর একজন ডাক্তার পাওয়া গেল। পরে জানা গেল এখন তিনি একাই ডাক্তার এখানে। রুগির বিবরণ শুনে লেবার রুমের একজন নার্সকে ডেকে পাঠালেন। রুগিকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সব দেখে শুনে রিপোর্ট দিতে বললেন। একসময় রুগি ছাড়া শুধু নার্স এলেন একটা কাগজ নিয়ে। ডাক্তার ইনজেকশন ওষুধপত্র যা লেখার লিখে দিলেন। রুগির বাড়ির লোকেদের বলা হলো ঘন্টাখানিক সময় লাগবে।  

বাইরে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হবে না ভেবে তারা দুজনই নৌকায় ফিরে এলো। অধীর বলতে বলতে আসলো যে ভগবানের অশেষ করুণা যে সময়মত তারা হাসপাতালে আসতে পারলো আর একটা ডাক্তারও পাওয়া গেল। দিবাকরের মনে অবশ্য দ্বিধা ভয় রয়ে গেছে।কারণ নিয়তিকে হাসপাতালে রেখে আসতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। উপায় নেই এতক্ষণ বসে থাকার। কে কোন কথা জিজ্ঞেস করবে তার কি ঠিক আছে! আবার এদিকে বাচ্চাদুটোকেও রেখে গেছে। নৌকায় এসে দেখে ভাত বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাতের মধ্যেই আলু সেদ্ধ দেয়া হয়েছে। আজকের রান্নার কাজ মৈত্যা করছে। ভালোই হলো। অধীর আর দিবাকর একদিকে বসে বসে বিড়ি টানছে। মাঝিদের সঙ্গে মাঝিদের একটা আত্মীয়তা থাকেই। পাশের নৌকার এক মাঝি  অধীরকে ডেকে কথা বললো । বলতে বলতে একসময় অধীর নিজে সে-ই নৌকাতেই গেল।   

এতক্ষণ খিদের কথা কেউ না বললেও ভাত হয়ে যাওয়ার পর তাদের খিদে লেগে গেল। বাচ্চাদের নিয়ে মইত্যা আর হানিফকে খেয়ে নেয়ার কথা বলল দিবাকর। এরমধ্যে অধীর ফিরে এলো এবং তারা দুজন আবার হাসপাতালের পথে হাঁটা দিল। যেতে যেতে অধীর দিবাকরকে বললো ---হুনেন জামাইবাবা ময়মনসিং যাওনের আর কাম নাই---ময়মনসিং থাইক্যা অহন বেক মানুষ ভাগতাছে---গেলে বিপদ খুব বেশি হইতে পারে---মায়রে লইয়া আর দেরি করন যাইতোনা---কাইল রাইতেই মুক্তির লগে মিলিটারির গোলাগুলি হইছে এইহানে---আমরারে আসতে দেইখা হেই মাঝিরাও অবাক হইছে---আইজ নাহি কার্ফু লাগবো। তারা হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়তিকে নিয়ে নার্স বাইরে এলো। এখন আর ডাক্তার নেই। আউটডোর ফাঁকা। নার্সই ওষুধ পত্র বুঝিয়ে দিল। বলল ইনজেকশন দেয়া হয়েছে । জ্বর আসতে পারে। চিন্তার কিছু নেই। কমে যাবে। পানি বেশি করে খাওয়াবেন। বাড়ি নিয়া যান। শরীরে রক্ত কম আছে। ভাল খাওয়াদাওয়া করাবেন। আর এই কাগজটা সঙ্গে রাখবেন যত্ন করে। রাস্তাঘাটে লাগতে পারে। বলে প্রেসক্রিপশনটা দিবাকরের হাতে দিল। আরো বললো যে পনের দিন পর আবার এখানে দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মনে মনে সবাই ভাবলো আর কি আসা হবে---।

নৌকায় ফিরে বাকি ভাত তারা খেয়ে নিল। নিয়তি খুব সামান্য খেল। খেয়ে ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। অধীর আর কাল বিলম্ব না করে নৌকা ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে নিয়তিকে দিবাকর চারদিকের পরিস্থিতির কথা বললো এবং শেষে বললো যে আমরা শ্রীমন্তপুর ফিরে যাচ্ছি। নিয়তির চোখে এবার এই প্রথম জল দেখলো দিবাকর। মনে মনে দিবাকর ভাবলো মরণ ছাড়া কোনকিছুইতো আমাদের হাতে নেই । ছৈ এর বাইরে এসে সে দেখলো তাদের নৌকা নেত্রকোনা ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তিনজন মিলে বাইছে।

২৯
নিয়তি শরীরে একটু তাপ বোধ করলেও এখন তার ভালো বোধ হচ্ছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। নার্স বললো সাবধানে থাকতে।ভারী কাজ না করতে। নার্স হাসপাতাল ডাক্তার---এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিয়তি ঘুমিয়ে পড়লো। দিবাকর বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ছৈয়ের বাইরে এসে বসলো। নিয়তি ঘুমোক। জলে জলে দিন কাটছে। কী অবস্থা হয়েছে দেশটার। বাঁচার আশা করতেও যেন শরীর কাঁপে। শ্রীমন্তপুর পর্যন্ত পৌঁছোন যাবে কিনা কে জানে। অধীর আর তার ছেলেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরনোর পর থেকে এই অবধি আবহাওয়া ভালই ছিল । কিন্তু আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। তাতে অবশ্য রোদের তাপ অনেকটা কম লাগছে। অল্প অল্প হাওয়াও দিচ্ছে। একসময় বাচ্চা দুটো দেখা গেল পাটাতনের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দিবাকরের ঘুম এলেও সে জেগে থাকার চেষ্টা করছে।

এতক্ষণ মনে হলো বিল পার হচ্ছিল তারা। বেলা পড়ে গেছে। এখন একটা খালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামনেই একটা বাজারের মত জায়গা দেখা যাচ্ছে। কিছু নৌকাও আছে। সাধারণত লোকালয়ে থামার কথা নয়। তবে অনেকক্ষণ হয়েছে ।এখন একটু বিশ্রামের দরকার আছে মনে হচ্ছে। দিবাকরের প্রশ্নের উত্তরে অধীর জানালো সামনের ওইটা লালচান্দের বাজার। এইহানে থামন যাইতনা। আরও সামনে গিয়ে থামন লাগবো। খালে নৌ চলাচল খুব কম। বাজারের কাছাকাছি হতেই তাদের নৌকাকে ইশারা করা হলো থামার জন্য। অধীর জলপথের নীতি অনুযায়ী নৌকা আস্তে করে ঘাটের দিকে নিয়ে গেল। দু একটা করে বাতিও এদিক ওদিক জ্বলে উঠছে। ঘাটে থামার পর ঘাটে দাঁড়ানো দুচার জন তাকে জিজ্ঞেস করলো---নাউ আহে কইথাইক্যা—যাইতাছে কই—ইত্যাদি। বোঝা গেল সাধারণ মানুষই।  কিছু খবর আছে কিনা জানার আগ্রহ তাদের। কিন্তু এরাতো ডাকেনি,ডেকেছে যারা তারাতো প্যান্ট শার্ট পরা ছিলো মনে হয়! তারা কই! অধীরের সঙ্গে এরা কিছু খবরাখবর বিনিময় করে চলেও গেল। যাওয়ার সময় বলেও গেল—সাবধানে যাইও মাঝি ভাই।  জলপথে যাতায়াত কি বন্ধ হয়ে গেল নাকি? সত্যি সত্যি তেমন সওয়ারী নাউ ত দেখা যাচ্ছে না! এদিকে নদীর পাড় বেশ উঁচু। নৌকা থেকে বাজার পুরো দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে মানুষজন কম।  

তবু থামাই যখন হলো,অধীর ভাবলো একটু খাওয়ার জলের সন্ধান করা যাক। সেই মত সে হানিফকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে খাওয়ার জলের সন্ধানে গেল । ইতিমধ্যে দুজন যুবক হঠাৎ কোথা থেকে যে উদয় হলো বোঝা গেল না—একেবারে নৌকাতেই এসে উঠে পড়লো। দিবাকর আর পরাণ দুজনই সপ্রশ্ন উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রশ্ন করার আগেই অবশ্য তারা বললো ভয়ের কিছুনা—আমরা দু একটা কথা বলতে এসেছি। বসেন বসেন--। নির্বাক দিবাকর আর পরাণ ওদের কথায় বসেও পড়লো। সেই একই প্রশ্ন। কোথা থেকে আসছেন—নৌকায় কে কে আছে-- যাবেন কতদূর—বাড়ি কোথায়—ইত্যাদি । নেত্রকোনা থেকে আসছে শুনে নেত্রকোনার কী খবর  জানতে চাইল। এরমধ্যেই দুই কলশী জল নিয়ে অধীর আর হানিফ এসে পড়ে। অতঃপর অধীরের সঙ্গে তাদের অনেকটা কথা হয়। কিন্তু আগন্তুক ছেলেদুটো যা বললো তা তাদের পক্ষে বেশ কঠিন। নদী পথ নৌকা শূন্য হয়ে পড়ছে এই জন্যই যে জল পথে মিলিটারি হামলা হবে এবার। গান বোট নেমেছে। মুক্তি যোদ্ধারাও প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানেও বেশি সময় থাকা নিরাপদ নয়। পরামর্শ করে ঠিক হলো যে এই বাজার থেকে চিড়ে গুড় কিনে নিয়ে, তাই খেয়ে তাদের তাড়াতাড়ি বিষনা্‌, ধরের খা্ল, গাইলা, এগুলো পার হয়ে হাঁসকুরি বিলে  পড়তে হবে। ওর পরে আর তেমন বিপদ নেই। তবে বিষনাই ধরের খাল এলাকাটি  বিপজ্জনক। সেই মত তাড়াতাড়ি করার জন্য আগন্তুকদের একজন দিবাকরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের খাবার আনতে চলে গেল।   

একজন একজন করে খাওয়া আর নৌকা বাওয়া একসঙ্গেই চলতে লাগলো। নিয়তির জন্য সামনের দিকটা ছেড়ে দেয়া হলো। বিপদের বার্তাটা নিয়তি পেলেও তার প্রতিক্রিয়া খুব কম।চোখে এখনও ভারি ঘুম তার।  তবু কোনোমতে জল দিয়ে চিড়েগুড় মেখে সবাই মিলে খেয়ে নিয়ে সে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ছৈএর ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। হাওয়াটা, তারা যত এগোচ্ছে তত ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে। এরমধ্যেই  মাঝে মাঝে দুটো বিড়ি  একসঙ্গে ধরিয়ে একটা অধীরকে দিয়ে নিজে একটা টানতে থাকলো দিবাকর। ভাবতে লাগলো ছেলে দুটো মুক্তিবাহিনীর কেউ না হয়ে রাজাকারও হতে পারতো। হতেই পারতো, কারণ মাত্র দুদিন আগে এই বাজার অঞ্চলটাকে রাজাকার মুক্ত করা হয়েছে। ওদের কথায় বোঝা গেল মুক্ত করা কঠিন কাজ হলেও মুক্তাঞ্চল ধরে রাখা আরও কঠিন।  আমরা এখন পর্যন্ত খুব অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে যাচ্ছি।

কখন দিবাকর ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারলো নৌকার দুলুনিতে। পরাণের কথায় দিবাকর বুঝতে পারলো তারা গাইলা আর হাঁসকুরির মাঝামাঝি এখন। অকুল সমুদ্রের মত জল আর ঢেউ। ঝড়ই হচ্ছে। অভিজ্ঞ অধীর নৌকার হাল ধরে বসেছে। এখন বেশি নৌকা বাওয়ার সুযোগ নেই। তবু পরাণ আর হানিফ সাধ্য মত টানছে। ভয় পেয়ে বাচ্চাদুটো এই প্রথম মাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। বৃষ্টি ততটা নেই শুধু হাওয়া। অগভীর এইসব বিল হাওরে ঢেউ সাধারণত বেশি উঠে। নৌকার পেছন দিকের ঢাকা সরিয়ে নিয়তি মুখ বের করে অধীরের উদ্দেশ্যে কয় ---কাহা, আমার ছেরা দুইডারে দেখুইনযে—পোলাপানডি সাঁতার জানে না। ---ভয় পাইয়োনা   বেডি—ঝড় বাদলত হয়ই---ভগবানরে ডাহ---। নৌকার পাটাতন সরিয়ে দিবাকর বালতি দিয়ে জল সেচতে লাগলো। নৌকার   ওঠানামাতে দুএকবার সে ঠোক্করও খেয়েছে। কিন্তু কাজটা করে যাচ্ছে। নৌকার মুখ ঢেউয়ের সঙ্গে কোনাকুনি রাখা বড় কঠিন কাজ। সবসময় নৌকা ঢেউয়ের সমান্তরাল হতে চায়। হতে দিলেই বিপদ। নৌকা উল্টে যাবে । অধীর সেই কঠিন কাজটা চোয়াল শক্ত করে করে যাচ্ছে কোনোমতে।  তবু ঢেউয়ের দাপটে নৌকা কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল। যেখানেই যাক, এ-সময় ঠিক মত ভাসিয়ে রাখাই একমাত্র কাজ।

৩০
দুপুরের দিকের শরীরের ভাললাগাটা নিয়তি আর টের পাচ্ছেনা। একটার পর একটা স্নায়ুপীড়ক ঘটনা তাকে একটা বড়ি খাওয়ার কথাও ভুলিয়ে দিয়েছে। এখন এই দুর্যোগ কীভাবে পার হবে ভাবতে ভাবতে আবার দুর্বল বোধ করে। গত কটা মাস তাদের আর কোন সমস্যা ছিল না, ছিল শুধু বাঁচার তাড়না। আজ আবার এই প্রকৃতির হাতের মার। ভাগ্যে কি তাহলে এই সলিল সমাধিই লেখা!

সবচে দুর্ভাগা এই গর্ভের সন্তানটি। এমন সময় তার আগমন যখন একটা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে মৃত্যু-উৎসব। উৎসবে সবাইকে যেন থাকতে হবে। ঘাতক অথবা নিহত হিসেবে। এটাই যেন সকলের যৌথ নিয়তি। সেখানে আজ মৃত্যুটা খুব বড় কিছু নয়। উৎসবটাই বড়। মানুষের অকাতর রক্ত মাংস হাড়গোড়ের পাহাড়ের শীর্ষে আজ কে থাকবে, কে থাকবে না সেটাই ঠিক হবে।   

এদিকে রাত মনে হয় শেষ হয়ে আসছে। ঝড়ের বেগ অনেকটাই কমেছে। অধীর ঠাহর করতে পারছেনা যে তারা এগিয়েছে না পিছিয়েছে। একটা খাড়ির মত জায়গায় তাদের নৌকা দুলছে। একটু আলোর আভাসে দেখা গেল কাছাকাছি একটা ডাঙ্গা। পাশাপাশি বিস্তীর্ণ শস্য প্রান্তর। কাছাকাছি ঘর বাড়ি নেই। খাড়ির ভেতর ঢেউয়ের দাপট একটু কম। জলের গভীরতাও কম। তবে জায়গাটা নিরাপদ  কিনা বোঝার উপায়  নেই। তবু লগি দিয়ে ঠেলে জোরের সঙ্গে নৌকাটাকে কিছুটা ডাঙ্গার উপর তুলে দিল অধীর। মাটিতে কিছুটা ধাক্কা খেয়ে তা থেমেও গেল।  হাত  থেকে হালের বৈঠা নামিয়ে রেখে অধীর ভিজে পাটাতনে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো। হানিফ আর পরাণও শুয়ে পড়লো। ঘাম আর বৃষ্টির জলে সবার জামাকাপড় ভেজা।  ভিজেছে দিবাকরও । ছৈয়ের ভেতরে কিছু কিছু জল ঢুকেছে।  বিছানার পাশে রাখা লাকড়িগুলোও কিছু ভিজেছে। নৌকা আর এগোচ্ছে না। বাচ্চারা এই অবস্থাতেও গভীর ঘুমে। এই সুযোগে দিবাকরকে নিয়ে নিয়তি নামল মাটিতে। বালতি নিয়ে দিবাকর নিয়তিকে একটু এগিয়ে দিয়ে নৌকার কাছেই ফিরে এসে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখল সামনে শুধু জল আর জল। ঝড় থেমে গেলেও ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস এখনও থামেনি। এদিকে সব অঞ্চলই দিবাকরের কাছে অচেনা। একমাত্র অধীরই বলতে পারবে জায়গাটা কোথায়।

মাটিতে নেমে দিবাকর আর নিয়তি যেন প্রাণ ফিরে পেলো। পায়ে নিচে ভেজা মাটির স্পর্শ যেন তাদেরকে বেঁচে থাকার জন্য আহবান জানালো। ঠাণ্ডা জলীয় হাওয়া বুক ভরে দুজনেই টানতে লাগলো। তারা ডাঙ্গা থেকে লক্ষ্য করলো ছৈয়ের উপর দিয়ে অধীরের মাথা দেখা যাচ্ছে। অধীর হয়তো চেষ্টা করছে জায়গাটা চেনার। দেখতে দেখতে অধীরও একসময় নৌকা থেকে নেমে তাদের কাছাকাছি এলো। এসে সে সুসংবাদটা শোনালো যে তারা রাজাখালি খালের মুখে এই খাড়িটাতে ঢুকে পড়েছে। আর চিন্তা নেই । আর একবেলার মধ্যে আশা করা যায় তারা আমিত্তিপুরের ঘাটে পৌঁছে যাবে। অধীরকে রেখে তারা দুজন নৌকায় ফিরে এলো। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। খবর শুনে হানিফ আর পরাণ লাফিয়ে উঠে প্রায়। তারাও ডাঙ্গা থেকে ঘুরে এসে কোন কথা না বলে জাল বের করে জলে নেমে পড়লো। বোঝা গেল আজ আর তারা কোন কথা শুনবেনা। মাছ খাবেই। কিছু শুকনো লাকড়ি বেছে নিয়ে নিয়তি ভাত বসিয়ে দিল। বাকি ভেজাগুলো উনানের পাশে রাখলো যাতে তাপে শুকিয়ে যায়। অধীরও ফিরে এসে জলে নেমে ভাল করে স্নান করে নিল। ছৈয়ের ভেতরে ঝোলানো পোটলার মধ্যে সামান্য কিছু জামাকাপড় তাদের থাকে। সেখান থেকে একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি নিয়ে পরে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাটাতন সরিয়ে একটা হাত দাও বের করে পরাণ ডাঙ্গার দিকে চলে গেল মাছ কাটবে বলে। ছোট বড় মাছ বেশ কয়েকটা ধরা পড়েছে। তার মধ্যে একটা বেশ বড়। সেটাই পরাণ খুব নিপুণ হাতে কাটলো। হানিফ কে দিয়ে নৌকা থেকে একটা থালা আনিয়ে মাছ ধুয়ে পরিষ্কার করে তাতে মাছ আর মাছের তেল আলাদা করে সাজিয়ে নিয়তির সামনে দিল। বাকি মাছ একটা ছোট্ট জালের টুকরোতে আটকে পাটাতনের নিচে চালান করে দিল। এরপর দুটিতে মিলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলো। শেষে অধীর ধমক দিয়ে দু জনকে জল থকে তুললো।

তারা যখন খেতে বসেছে তখন সূর্য উঠে গেছে। নিয়তি  ছেলেদের ভাবসাব দেখে চাল বেশিই নিয়েছিল। আলুসেদ্ধ, মাছের ঝোল আর  মাছের তেলের বড়া। ছেলে দুজন খেতে বসার আগেই চেয়ে নিল দুটো করে তেলের বড়া। তাদের আনন্দ দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই যে তারা সাংঘাতিক বিপদের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। উঠতি এই উচ্ছ্বাসময় কত জীবনই হয়তো এই চলমান নৈরাজ্যের কাছে  বলি হয়ে গেছে। তবু এই সেই জীবন যেখানে শত মালিন্য নৈরাশ্য ঠাঁই নিতে পারে না। আহারান্তে সকলেই কিছুটা সময় বিশ্রাম নিল। অধীর আর  দিবাকর গল্প করলো বিড়ি খেল। ঠিক হলো যে বিকেলের মধ্যেই পৌঁছাতে হবে। এবং সেটা একটানা। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে থামাথামি নেই। অধীর বললো ---আফনেরা ঘুমাইয়া লইন---রাইতভর যা গেছে---আমরা এক্কেরে বাড়িত গিয়া ঘুমাইয়াম।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য