লেখকসত্তা মূলত বায়বীয় চিন্তাসত্তা, যতক্ষণ না পাঠকসত্তার আবির্ভাব ঘটে- রণদীপম বসু

একুশে গ্রন্থমেলার লেখক-পাঠকের অপূর্ব মিলনমেলা। আমরা সিলেটটুডে২৪.কমের পক্ষ থেকে মুখোমুখি হয়েছি লেখক-প্রকাশকদের সাথে। এবারের পর্বে কথা বলছেন কবি, গবেষক রণদীপম বসু

 প্রকাশিত: ২০১৫-০১-১৮ ০২:২৩:১০

 আপডেট: ২০১৫-০১-২২ ১৬:৩৬:৫৯

নিউজ ডেস্ক:

রণদীপম বসু কবি, গবেষক। এর বাইরে বড় এক পরিচয় বাংলাব্লগের খুব পরিচিত এক নাম, ব্লগার। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও নিকট অতীতে গবেষণা নিয়ে যতখানি ব্যস্ত কাটিয়েছিলেন তার সামান্যই ছিল না অন্য দিকে। দীর্ঘ ছ-সাত বছরের পরিশ্রমের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেছেন এক গবেষণাগ্রন্থ ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’। বইটি ইতিহাসের আলোকে যুক্তির নিরিখে লিখিত- কে জানে ইতিহাসকে যুক্তির মানদণ্ডে খুঁজতে কিংবা লিখতে গিয়ে লিখা হয়ে গেলো কীনা অন্য কোন ইতিহাস! এর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে কিছুদিন! 

বর্তমানে ঢাকাবাসী হলেও জন্মস্থান সুনামগঞ্জ। হাসন-করিমের বাতাসে শৈশব কাটিয়েছেন বলে এখনও গায়ে লেগে আছে সে রূপ-রস আর গন্ধ। লিখতে ভালোবাসেন, পড়তে ভালোবাসেন আর পড়তে গিয়ে পড়াবার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিলেন অবলীলায়। আসছে বইমেলায় প্রকাশিতব্য গবেষণাগ্রন্থ ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’ দীর্ঘ গবেষণালব্ধ এক পরিশ্রমি কাজ বলে আগ্রহীজনদের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠবে তা বলা যায় নির্দ্বিধায়। 

সিলেটটুডে২৪’র সাথে তাঁর নিজের লেখালেখি, বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় এবং বইমেলা নিয়ে কথা বলেছেন খোলাখুলিভাবে। বিস্তারিত পাঠকদের উদ্দেশে:

সিলেটটুডে২৪: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫-তে আপনার কী বই আসছে? 
রণদীপম বসু: হাঁ, বরাবরের মতোই এবারও অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে সামনে রেখে একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। তবে এবারের বইটা ভিন্নধর্মী এবং দীর্ঘ গবেষণামূলক একটা কাজ। যার পেছনে আমাকে বিরতিহীন ছ-সাতটি বছর প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। আমরা জানি যে, ভারতীয় দর্শনের অপার সমৃদ্ধ ভাবনা ও জ্ঞানজগতে প্রাচীনতম জড়বাদী তথা প্রখর বস্তুবাদী দর্শন বলতে নাস্তিক শিরোমণি চার্বাক-দর্শনই একমাত্র অবলম্বন আমাদের। যাকে বার্হস্পত্য বা লোকায়তিক দর্শন নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতীয় চিন্তাজগতে সকল ধরনের কাল্পনিক অলৌকিকতার বিরুদ্ধপথিক এবং পূর্ণাঙ্গিক যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তার অগ্রপথিক এই চার্বাককে নিয়ে আমাদের ভাবনা জগতে এক ধরনের উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে কিংবা ছড়ানো হয়েছে সেই কয়েক হাজার বছর আগেই থেকেই।  
কোন অজ্ঞাত কারণে চার্বাকদের সমস্ত নিজস্ব সাহিত্যের অবলুপ্তির কারণে তাঁর প্রতিপক্ষ অধ্যাত্মবাদীদের যুক্তিবহির্ভূত নিরবচ্ছিন্ন নিন্দা ও উদ্দেশ্যমূলক বিরুদ্ধতায় এই বিভ্রম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি কখনোই। তারপরও মুক্তদৃষ্টিসম্পন্ন আধুনিক গবেষকরা বসে থাকেননি। তাঁদের নিরন্তর শ্রম ও গবেষণায় বিভিন্ন ভারতীয় প্রাচীন দর্শন সাহিত্য, সূত্র, টীকা, ভাষ্য, বিপুলাকার বেদ-সাহিত্য তথা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, পুরাণ, শ্রুতি-স্মৃতি সহ তাবৎ শাস্ত্র ও ইতিহাস, কাব্য, নাটক ইত্যকার যাবতীয় নিদর্শনাবলী ঘেটে-ঘুটে চার্বাক-দর্শনের একটি রূপরেখা আঁকার প্রচেষ্টা হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। তার উপর ভিত্তি করেই সেই সুপ্রাচীন সিন্ধুসভ্যতা থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ হয়ে বিভিন্ন অধ্যাত্মবাদী প্রাচীন ধারণাগুলোর উদ্ভব ও পল্লবিত হওয়ার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ ও তার যৌক্তিক অসারতা প্রমাণে লোকায়তিক মতগোষ্ঠির ভূমিকাসহ এ যাবৎ চার্বাক সংশ্লিষ্ট প্রাপ্ত বিপুল নিদর্শনাবলী যথাযথ সংরক্ষণ ও উপাস্থপন করে মানবসভ্যতার ভাবনা-পরম্পরার মাধ্যমে সাধারণ পাঠকের বোধগম্য করে চার্বাক-দর্শনের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা অঙ্কনের প্রয়াস নেয়া হয়েছে এই গ্রন্থটিতে।  এবং তারই চূড়ান্ত ফলাফল হলো এবারের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রসিদ্ধ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘শুদ্ধস্বর’ থেকে প্রকাশিতব্য প্রায় সাড়ে আটশ’ পৃষ্ঠার সুপুষ্ট গ্রন্থ ‘চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন’। 

সিলেটটুডে২৪: আপনার প্রকাশিত বই সংখ্যা কত? 
রণদীপম বসু: এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বই সংখ্যা আটটি। 
অদৃশ্য বাতিঘর (কবিতা), খোকার জানালা (কিশোর কবিতা), তিন দশে তেরো (ছোটদের ছড়া-পদ্য), ইয়োগা- সুস্থতায় যোগচর্চা (যোগ-ব্যায়াম ও স্বাস্থ্য), অবমুক্ত গদ্যরেখা (গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন), উৎবচন (মুক্তচিন্তক ভাবনা), টিপলু (কিশোর গল্প), চতুষ্পদী কষ্টগুলি (অণুকাব্যগুচ্ছ)। 

সিলেটটুডে২৪: অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আপনার প্রত্যাশা কী? 
রণদীপম বসু: অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ এখন। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ ভাবুকদের ভাবনা, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা আর অবারিত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সংহত রূপ-কে ধারণ করেই গোটা জাতির সামগ্রিক চিন্তা-সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। 
লেখক-পাঠক-প্রকাশক-আয়োজক-কর্মী-দর্শনার্থী-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ইত্যাদি বিভিন্ন কর্ম ও পরিচয়ে বাঙালি চেতনার বিপুল স্রোতস্বী  হয়ে এখানে যারা আসেন, সমবেত হন, নিজস্ব মহার্ঘ মুহূর্তগুলো রাঙিয়ে নেন নিজের মতো করে, তাঁরা প্রত্যেকেই এই মহামেলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতএব অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আমার প্রথম প্রত্যাশাই হলো আমাদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চিন্তাগত ঐক্য-অনৈক্য যা-ই থাকুক না কেন, অন্তত এই মেলাটাকে ঘিরে যেন জাতি হিসেবে আমরা আমাদের গর্বের ধন মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও চেতনাগত মৌলিক একাত্মবোধনের জায়গাটাকে নিবিড়ভাবে মনন ও উপলব্ধিতে ধারণ করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত করার চেতনাকে আরো শাণিত করে তুলতে পারি। 

সিলেটটুডে২৪: অমর একুশে গ্রন্থমেলা কিভাবে আরো আকর্ষণীয় করা যায়? 
রণদীপম বসু: মেলাকে আরো আকর্ষণীয় বলতে সর্বাগ্রেই মেলার পরিসরের বিষয়টাকে বিবেচনায় রাখতে হয়। মেলায় যে বিপুল দর্শক-পাঠকের সমাগম ঘটে তাতে হামলে পড়া ভয়ঙ্কর ভিড়ের গিজগিজে ঠেলাঠেলির মধ্যে একজন নিবিষ্ট পাঠক কিংবা দর্শক কোন স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে একটু অবসর নিয়ে ওলটে-পালটে কাঙ্ক্ষিত বইপত্রগুলি যাচাই করে দেখা তো দূরের কথা, কোনভাবে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেই যেন বেঁচেবর্তে যায়। নারী, শিশু ও বয়স্কদের কথা আর নাই বললাম। অন্তত এখন পর্যন্ত এ অভিজ্ঞতাটাই একুশে বইমেলার সবচাইতে যন্ত্রণাকর ও বইমেলার প্রকৃত উদ্দেশ্যের সাথে একান্তই সঙ্গতিহীন আবহ বলে প্রতীয়মান হয়। 
গত বইমেলায় বাংলা একাডেমির নিজস্ব অঙ্গন ছাড়িয়ে মেলা-পরিসরকে দুই ভাগে ভাগ করেও এই সমস্যার সুরাহা তো হয়ই নি বরং তার সাথে অতিরিক্ত সমস্যা হিসেবে যুক্ত হয়েছে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্প্রসারিত অংশে বাথরুম ব্যবস্থাপনা না রাখার এক অপরিণামদর্শী ভাবনা ও আয়োজন। আশা করি এবার অন্তত এরকম অপরিণামদর্শিতা প্রতিফলিত হবে না। আর উদ্যানের অংশে যদি এবারও মেলা সম্প্রসারিত হয় তাহলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে দর্শনার্থীদের জন্য আবশ্যক সুবিস্তৃত পরিসর রেখেই স্টলগুলোকে বিন্যস্ত করার দিকে মনোযোগ দেয়াটা মেলার পরিবেশের জন্য একান্তই অপরিহার্য মনে করি। স্টল সংখ্যার পুষ্টি বিচার করে কী হবে, পাঠক-ক্রেতার সাচ্ছন্দ্যবোধই যদি না থাকে তাইলে আর যা-ই হোক, নামে গ্রন্থমেলা হলেও তা গ্রন্থমেলার মহৎ উদ্দেশ্য ও মহিমাকেই ম্লান ও বিচলিত করে তুলবে। অন্য আকর্ষণ তো দূরের ব্যাপার ! 

সিলেটটুডে২৪: একুশে গ্রন্থমেলায় নিয়মিত যান? কী কারণে? 
রণদীপম বসু: তীব্র ইচ্ছা থাকলেও ছুটির দিনগুলো ছাড়া গ্রন্থমেলায় নিয়মিত যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। কর্মস্থলের দূরত্ব আর  ঢাকা নগরীর যানজটে আকীর্ণ আন্ত-যোগাযোগ ব্যবস্থার যে করুণ হাল, তা উপেক্ষা করে মেলা পর্যন্ত পৌছানো যাবে হয়তো। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের সাপেক্ষে মেলার গেট থেকে ফিরে আসাটা হবে নিতান্তই পরিহাসের ব্যাপার।  এই পরিহাসের চাইতে নিয়মিত যেতে না-পারার অতৃপ্তি হজম করাটাই হয়তো অধিকতর সান্ত্বনার। 

সিলেটটুডে২৪: লেখালেখিতে কোন বিষয়টিকে আপনি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন? কী যুক্তি এর পেছনে? 
রণদীপম বসু:  যুক্তিহীন বিশ্বাস ও বদ্ধচিন্তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবোধে তাড়িত মুক্তচিন্তা প্রসূত সৃজন ও মননশীল ভাবনাধারাকে প্রকাশ ও পরিচর্যা করার আকাঙ্ক্ষাই আমার নিজস্ব অক্ষরস্রোতের প্রাণস্পন্দন। আমার সীমাবদ্ধ কলমে তার  যেটুকু প্রকাশ ঘটে সেটুকুই আমার লেখালেখির দৃশ্যমান ঘরগেরস্থালি। আর যেটুকু এখনো প্রকাশিত নয় সেটুকু আমার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার অদৃশ্য আগামী হয়ে থাকে। এর পেছনের যুক্তিটা তো প্রাচীন গ্রিক কবি ইউরিপিডিসই (৪৮০-৪০৬ খ্রিস্টপূর্ব) সেই কোন্ কালে দিয়ে গেছেন আমাদেরকে- ‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই, তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভালো।’ এর চেয়ে বড় যুক্তি আর কী হতে পারে ! 

সিলেটটুডে২৪: আপনার বই আর পাঠক এবং আপনি আর অন্যান্য বই এ সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন?  
রণদীপম বসু:  লেখকসত্তা মূলত একটা বায়বীয় চিন্তাসত্তা, যতক্ষণ না পাঠকসত্তার আবির্ভাব ঘটে। এবং প্রকৃতপক্ষে লেখক অস্তিত্ববান হন পাঠকের অস্তিত্বে। তাই বই প্রকাশের আগ পর্যন্ত লেখক নামের কাল্পনিক ব্যক্তিসত্তাটির যতো জারিজুরিই থাক, প্রকাশের পর প্রকাশিত বই মূলত আর লেখকের থাকে না, তা পাঠকের অধিকারে চলে যায়। সেক্ষেত্রে পাঠকের মূল্যায়নের মধ্যেই লেখকের প্রকৃত বিকাশ। এটাই লেখকের অস্তিত্ব। কিন্তু লেখকসত্তা যতো বায়বীয়ই হোক না কেন, যেহেতু তিনি একটি চিন্তাসত্তাও বটে, তাই পাঠকসত্তার সৃষ্টি ও বিকাশেও  লেখকের একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দায়বদ্ধতা থেকেই যায়, এবং সেটি হলো তিনি কোন্ প্রকারের বা কী ধরনের পাঠক সৃষ্টি করছেন বা পাঠকের কোন্ সত্তাটিকে বিকশিত করছেন বা করার চেষ্টা করছেন। আমার বইকে যদি আমার চিন্তাসত্তার প্রতিবিম্ব বলে স্বীকার করি সেক্ষেত্রে প্রশ্নশীল অনুসন্ধিৎসু পাঠকই আমার কাক্সিক্ষত পাঠকসত্তা। আমি সেই পাঠকসত্তাকেই খুঁজি কিংবা তৈরি করতে চাই। এই অনুসন্ধিৎসাকে যে পাঠক সমর্থন করেন, লেখক হিসেবে আমি তাঁর কাছেই তো সত্তাবান হয়ে ওঠি। এই মিথষ্ক্রিয়ার মধ্যেই লেখক হিসেবে আমার ও পাঠকের সাথে এক অদৃশ্য কিন্তু সত্তাময় সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়। 
একইভাবে অন্যান্য বই তথা লেখকের সাথে একজন পাঠক হিসেবে আমারও সম্বন্ধ তৈরি হয় অনুরূপ মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমেই। সবচাইতে বড় কথা হলো, একজন লেখক আসলে প্রথমত একজন পাঠক এবং নিষ্ঠাবান পাঠকই। জাগতিক সবকিছুই তো সম্বন্ধের রকমফের মাত্রই। 

সিলেটটুডে২৪: বই প্রকাশে আপনি কী ধরণের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন? কিভাবে উত্তরণ ঘটল? 
রণদীপম বসু: অর্থনীতির মারপ্যাঁচে বাজার অর্থনীতিতে জগতের সকল কিছুই যখন পণ্য হিসে গণ্য হয় সেখানে বিনিয়োগ-ব্যবসা-আয়-ব্যয়-লাভালাভের খতিয়ান টানলে প্রকাশনা একটি ব্যবসা ও শিল্প তো বটেই। আর প্রকাশনা শিল্পের বিনিময়যোগ্য চূড়ান্ত পণ্যটি হলো বই। লাভের খতিয়ান ভারি ও নিশ্চিত না হলে পণ্য তৈরিতে বিনিয়োগ হবে কেন ! একজন প্রকাশক প্রথমত একজন পুঁজি লগ্নিকারী ব্যবসায়ী। ক্রেতাপাঠককে আকৃষ্ট করে এই ব্যবসাটুকু নিশ্চিত করার পরই তাঁর অন্য কোন মহৎ আদর্শ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে পারে তাঁর প্রকাশনায়। আর একজন লেখক এই প্রকাশনা শিল্পের অতি-গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান হলেও লগ্নি-সামর্থহীন লেখককে সম্পূর্ণই নির্ভর করতে হয় পাঠকের নিজস্ব রুচি কিংবা লেখকের অভীষ্ট অনুযায়ী পাঠকরুচি নির্মাণের উপর। গ্রন্থপণ্যের চাহিদা তৈরিতে একজন লেখককে এই দু’ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। লেখকের নিজস্ব সত্তা বিসর্জন দিয়ে পাঠকের তরল রুচিতে ভেসে যাবেন, না কি অভীষ্ট অনুযায়ী পাঠকরুচি নির্মাণ করবেন। 
ব্যক্তিগতভাবে লেখক হিসেবে আমি দ্বিতীয় ঘরানার বলেই অর্থসংগতিহীন আমাকে প্রতিনিয়তই প্রতিবন্ধকতা কেটে কেটেই এগুতে হয়। আধুনিক ইন্টারনেট যুগের আবির্ভাব ও তার আনুকুল্যে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ব্লগিংকে সম্বল করে নিজেকে প্রকাশের অবারিত সুযোগ নিজের অজান্তেই হয়তো একটা গোষ্ঠিপরিচয় এনে দিয়েছিলো আমাকে। আর তাই মননশীল মুক্তচিন্তক সংস্কৃতবান পাঠকের আগ্রহই আমার প্রতিবন্ধকতা উত্তরণের প্রধান সহায়। 
তবে এক্ষেত্রে শুদ্ধস্বর প্রকাশনার সত্ত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল সাহেবকে প্রকাশনা জগতে মুক্তচিন্তা প্রসারের সামাজিক দায়বোধ থেকে ব্যক্তিগত আদর্শ লালনে দৃঢ় অবস্থান এবং সমুদয় আর্থিক ও পারিপার্শ্বিক ঝুঁকি গ্রহণের সাহসিকতায় অবশ্যই ভিন্নমাত্রিক ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করি। নইলে আমার মতো একজন লেখকের কলম যতোটা গ্রহণযোগ্যই হোক, গ্রন্থ হিসেবে তা চিন্তাশীল পাঠকের দরবারে এতো সহজে পৌঁছানো যেতো কিনা সন্দেহ। 

সিলেটটুডে২৪: প্রকাশিত, প্রকাশিতব্য বই আর প্রকাশক(দের) সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন 
রণদীপম বসু: পূর্ববর্তী প্রশ্নের উত্তরেই আমার মূল্যায়নটা ভিন্নভাবে এসে গেছে মনে হয়। তারপরও প্রকাশিত বা প্রকাশিতব্য বইয়ের লেখক ও প্রকাশকদের প্রতি আমার বিনীত নিবেদন থাকবে, আর যা-ই করি না কেন, সমাজ ও জাতির প্রতি আমাদের ন্যূনতম একটা দায়বদ্ধতাবোধ যেন আমাদের সামগ্রিক কর্মকান্ডে জড়ানো থাকে। অনিয়ন্ত্রিত প্লাবনে একেবারে সমূলে ভেসে না গিয়ে প্রকাশনা শিল্পে আমাদের চিন্তা ও কর্মে একটা সাংস্কৃতিক মানদন্ড যেন আমরা রক্ষা করে চলি। কেননা আমরাই তো জাতির শেষ প্রজন্ম নই, আরো প্রজন্ম আছে, জবাবদিহিতার প্রশ্নও আছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। গ্রন্থপ্রকাশের নামে ইচ্ছেখুশি যা কিছু করার লাগাম টানাটা আমাদের জন্যই জরুরি। 

সিলেটটুডে২৪: সিলেটটুডে২৪.কম’র পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। 
রণদীপম বসু:  আপনাকেও ধন্যবাদ এবং আপনার মাধ্যমে সকল পাঠককে আমার কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।


গ্রন্থনা: ক.য়া/ জানুয়ারি ১৮, ২০১৫

আপনার মন্তব্য