একটি সাদা কবুতরের প্রতিক্ষা

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-১৪ ১৫:১৫:২০

 আপডেট: ২০১৭-০৮-১৫ ০৯:১৩:২৯

সোলায়মান সুমন :

ঘুলঘুলি ফোকর গলিয়ে ধারালো আলোর ঝলকানি এসে ছোট্ট কুঠুরিটা রাঙিয়ে দিল। সে আলোয় অমসৃণ দেয়ালে মহানবন্দি নিজের ছায়া দেখতে পেলেন। অতঃপর রুদ্রমেঘের জোরালো হুঙ্কার। পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলের পুরু প্রাচীরগুলো আতঙ্কে কেঁপে উঠল।

বাইরের প্রকৃতি ভীষণ রুষ্ঠ। ঝড়ের তা-বের পর এই মাত্র বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মহান বন্দির চোখ এবার বাংলার মাঠ ঘাট আকাশ নদী চষে বেড়ায়। বাংলার কোনো এক সবুজ গ্রামের কাঁঠাল গাছের ডালে বসে একটি বিষণ্ণ কাক ভিজছে নিশ্চুপ। কাঁঠালের পাতা চুয়ে জল পড়ছে ওর শরীরে। অনেক ঝড়, অনেক বজ্রপাত, অনেক জলের বর্ষণের পর এবার শ্যামল বাংলা শীতল হবে।

বিষণ্ণ কাকটির চোখে মুখে তার স্বপ্ন। কখনো কখনো বাংলার বর্ণহীন বৃষ্টির জল রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে- রক্তবৃষ্টি ঝরে গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়। বিশ্বের জাদরেল বিজ্ঞানীরা কারণ খুঁজতে ব্যস্ত। কাকটি কাকা করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু বৃষ্টির জলে সে চোখের জল ধুয়ে যায় খুব সহজে। মহান বন্দি তাঁর চোখ মুছে জেলকুঠুরির ঘুলঘুলিটার দিকে এগিয়ে যায়। তাঁর নির্ভীক পদধ্বনিতে গারদঘেঁষা প্রহরিটির ঝিমুনি ছুটে যায়, কেয়া হুয়া?
মহানবন্দি কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁর শখের পাইপে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার মাঝে ঠোঁটের ভাঁজে রহস্য ছড়িয়ে দেয়।
প্রহরির ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কিন্তু বাইরে সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে।

মহানবন্দি বিড়বিড় করেন, ‘বাইরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে তাই আমার পায়রাটা আজ আসেনি।’ দুপুরে তাঁর আজ খাওয়া হয়নি- পায়রাটা যে আসেনি। পায়রাটির সাথে তিনি দুপুরের খাবার সারেন। একা একা তিনি কোনো দিনও খেতে পারেন না। এটি তাঁর বহু দিনের পুরনো অভ্যাস। বৃষ্টি থেমে গেলে পায়রাটা যখন ঘুলঘুলিতে এসে বসবে, তারা এক সাথে খাবার খাবে।
মহানবন্দি প্রহরিকে বলেন, ‘আমার পায়রাটা কোনো এক ভেজা কাকের কাছে আমার গল্প বলতে বাংলায় গেছে। ও ফিরে আসবে।’ ধোঁয়ার আঁধারেও প্রহরি তাঁর দীপ্তচোখ স্পষ্ট দেখতে পায়।
প্রহরি ভীষণ বিব্রত। সে অসহায় কোনো বিড়াল ছানার মত চোখ দুটো কুত-কুত করতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর জিন্নাহ টুপি পরা এক ব্যক্তি এসে জেলকুঠুরির গারদ ঘেঁষে দাঁড়ায়। মহানবন্দি তখন মনোযোগের সাথে বৃষ্টির কবিতা শুনছিল। আর পাইপ থেকে থোকা থোকা মেঘ ছড়াচ্ছিলেন। জিন্নাহ টুপি পরা ব্যক্তিটির দিকে একবার তাকিয়ে তিনি মাথা নামিয়ে নেন। ব্যক্তিটির গোর খোদা থ্যাবড়ানো নাক, কালচে মেটে বর্ণের চেহারা দেখলে সহজেই বোঝা যায়, সে পশ্চিমের নয়। কিন্তু পোষাকে পশ্চিমি হবার জোর আকুতি রয়েছে। কাবলির উপরের প্রিন্সকোটটা ওর বেমানান ধরনের আঁটোসাঁটো।
মহানবন্দি তখনো মগ্ন বৃষ্টির শব্দে। কিছু বলবে? ব্যক্তিটির দিকে না তাকিয়েই তিনি বলেন। লোকটির দৃঢ় বলিষ্ঠ কণ্ঠ ব্যক্তিটির কানে বজ্রের মত শোনায়। জেনারেলের সাজিয়ে দেয়া কথাগুলো ওর ঠোঁটে এলোমেলো হয়ে যায়। বিড়বিড় করে আয়তাল কুরসি পড়তে থাকে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে।
মহানবন্দি আবার বৃষ্টির ফোটায় লালন’র এক তারার সুর শুনতে থাকেন।

ভাইসাব, ব্যক্তিটি বুকে ফুঁ দিয়ে বেশ জোরের সাথেই বলে চলে, ঐ যে গোর খোদাই চলছে সেটা কিন্তু আপনার জন্য। কাল সকালে আপনাকে ঐ কবরে শোয়ানো হবে। তবে এখনো সময় আছে। আপনি যদি সব ভুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন, সামরিক আদালতে দেয়া আপনার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে দিবেন জেনারেল। আগে নিজ প্রাণ তারপর না দেশ সেবা! একটা কথা আছে না, জান বাঁচে তো লাখো পায়ে।
তুমি তাহলে ক্ষুধার্ত শকুনের কাছ থেকে আমার জীবনের খবর নিয়ে এসেছ?
মহানবন্দি এবার স্থির দৃষ্টিতে দূরের কবর আর গোর খোদকের দিকে তাকায়। ধপধপ শব্দে মাটির বুকে কামড় বসাচ্ছে রাক্ষুসী কোদাল। বৃষ্টির জলে ভিজে যাচ্ছে কবরের জমিন। লোকটি সংশয়ের কণ্ঠে বলে, ওরা কি আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌছে দিবে না?
ব্যক্তিটি এ প্রশ্নের উত্তর জানে না। বিষয়টা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। তারপরও হঠাৎ জন্মভূমির মাটির সোঁদাগন্ধে ব্যক্তিটির কৃতজ্ঞ হৃদয় কেঁপে ওঠে।

মহানবন্দির কণ্ঠ এবার বাইরের বজ্রপাতের শব্দকে ছাপিয়ে ওঠে, আমাদের মানুষ লড়তে শিখেছে। এখন আমার কাজ শেষ হয়েছে। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। তোমরা আমাকে মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।

প্রিন্সকোট আর জিন্নাহ টুপি পরা সেই ব্যক্তিটির চেহারা থেকে রক্ত সরে গিয়ে খাঁ খাঁ মরুভূমির বালুর মত রুক্ষ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। সে বিষণ্ণ মনে জেনারেলের অফিসের দিকে এগোয়। লোকটি পাহাড়ের মত অটল; একে টলানো যাবে না। মনে হয় না কোনো ধরনের ভয় দেখিয়ে জেনারেল তার কাজ হাসিল করত পারবে।

জেনারেল অফিসে টেবিলে পা তুলে বসে ছিল। সে বড় ক্লান্ত, বিষণ্ণ। জেলের সেই লোকটি তার গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। লোকটি যে তাদের কাছে আছে সেটা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে স্বীকার না করলেই পারত। এখন ওকে না পারছে হত্যা করতে না পারছে মুক্ত করে দিতে। ব্যক্তিটির মুখের দিকে তাকিয়ে জেনারেল ভীষণ বিরক্ত ও রাগান্বিত হয়। এসব বাঙালি দিয়ে কোনো কাজ হবে না। যে নিজের জন্মভূমির হতে পারল না, সে আবার তাদের আপন হবে কী করে। জেনারেল বলে ওঠে, হট হ্যাপেন ম্যান? তুম লোগ ক’ই কাম কি নাহি।
হুজুর উনাকে ভয় দেখিয়ে কাম হাসিল করা ওতো আসান নাহি। যে লোক দেশের জন্য যৌবনের প্রায় পুরোটা জেলে কাটিয়েছে তার কি মরণ আর জেলের ভয় থাকে স্যার।
হট হি ওয়ান্ট?
ওর ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া পাওয়া নাই স্যার।
হট!জেনারেলের হুঙ্কার আর আচমকা বুটের শব্দে ব্যক্তিটি ভয় পায়।

মহানবন্দি এবার বৃষ্টির শরীরে বাংলার বরষার কাদা-জলের মাঠে বেড়ে ওঠা সাধারণ মানুষের অস্ত্রহাতে এগিয়ে যাওয়া পায়ের থপ থপ শব্দ কান পেতে শুনতে থাকেন। ওরা ছোট ছোট দলে শহরে গ্রামে, অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর হৃদয় বাংলার বুকে রচে চলা বীর বাঙালির মহাকাব্য শোনাতে থাকে। এবার জিন্নাহ টুপির সেই ব্যক্তিটির সাথে জেনারেল এগিয়ে আসে জেলকুঠুরির গারদের কাছে। নির্মোহ দৃষ্টিতে মহানবন্দি জেনারেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

জেনারেলের ফাটা বাদামের খোসার মত বিমর্ষ মুখ দেখে তাঁর মুখে আশাবাদের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। জেনারেলের সত্যি মন খুব খারাপ। মাঝে মাঝেই টেলিফোনে খারাপ খবর আসছে পূর্ব পাকিস্তানের রণক্ষেত্র থেকে। বর্ষায় পাকসেনারা একেবারে নাস্তানাবুদ। সাধারণ মানুষ প্রতারণা করেছে পাকসেনাদের সাথে- ভুল তথ্য দিচ্ছে, কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করছে না। কিছু সংগঠনের হাতে গোনা কিছু কর্মী সহযোগীতা করছে মাত্র।

রসদ শেষ হয়ে আসছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যাবার জলপথ বন্ধ হয়ে গছে। রসদ, সৈন্য যাবে কীভাবে। পৃথিবীর অন্যতম সেনাবাহিনী মাত্র নয় মাসে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আবার আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়ছে। এই লোকটির মানসিক শক্তি কোনোভাবে যদি দুর্বল করে ফেলা যায় তবেই হয়ত কিছু করা সম্ভব।

সামরিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, তাঁর চোখের সামনে তাঁর কবর খোঁড়া হচ্ছে তারপরও সে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল অবিচল। এতটুকু টলে না। কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে চায় না সে। জেনারেল নিজে আবার অন্যদের দিয়ে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে, আসুন যুদ্ধ বন্ধ করে সমঝোতার মাধ্যমে এখন একটা সমাধানে আসি। পাকিস্তানের ভবিষ্যত নির্মাণের দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হবে। সমস্ত পাকিস্তানের মসনদে আপনি বসবেন। কিন্তু মহানবন্দিটি কিছুতেই রাজি না। এও বলা হয়েছে, আপনি রাজি না হলে কিন্তু সামরিক আদালতের রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আমেরিকা আমাদের পাশে রয়েছে। আমাদের ভয় কীসের? লোকটি সব শুনে শুধু হাসে, ডু, হট্ ইউ ক্যান। নাও, উই আর নট স্লিপিং।
এক মেজর হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে আসে জেনারেলের দিকে। জেনারেলকে ফিসফিসিয়ে কী যেন বলে।

লায়ালপুরের বৃষ্টি থেমে বিকেলের আলো গোলাপি হয়ে উঠছে কিন্তু জেনারেলের মুখে যেন মেঘ জমেছে- ভীষণ কালো দেখাচ্ছে ওকে। সে জিন্নাহ কোট পরা ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ওঠে, জো হোগা দেখা যায়ে গা। লোকটিকে দেখিয়ে বলে, উসকো কাহো। উস্কা ওয়াক্ত সমাপ হুয়া। আব উস্কো মার না পাড়ে গা।
হালকা হাসি মুখে ছড়িয়ে দিয়ে লোকটি বলে, আমিন। আল্লাহর সব সিদ্ধান্তে আমি সন্তুষ্ট। একটাই অনুরোধ আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পৌছে দিও।
জেনারেলের ক্লান্ত কাঁধে মাথাটা নিচের দিকে ঝুলে আসে।

মহানবন্দি বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ আনন্দে হেসে উঠেন। প্রায় চিৎকার করে বলেন, ঐ যে বৃষ্টি থেমেছে। এবার আমার সাদা কবুতর ফিরে আসবে।
তাঁর কথা বুঝতে না পেরে জেনারেল বলেন, কেয়া?
মহানবন্দি আবার বলেন, আমার সাদা কবুতরটা এবার ফিরে আসবে।

জিন্নাহ কোট পরা বাঙালি ব্যক্তিটির দিকে জেনারেল কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ব্যক্তিটি জেনারেলের কৌতূহল মেটাতে বলে, হুজুর পানছি। আজাদ পানছি।

জেনারেল পরাস্ত চোখে মহানবন্দির দিকে তাকায়। এরই মধ্যে মহানবন্দিটি খাবারের প্লেট হাতে জেলকুঠুরির ঘুলঘুলিটির সামনে দাঁড়িয়ে সুর করে ডাকতে শুরু করেছে, আয় আয় আয়।

আপনার মন্তব্য