হুমায়ুননামা এবং একজন হেরেমবাসিনীর গল্প- ৫

গুলবদন ছিলেন বাদশাহ হুমায়ুনের বোন, আকবরের ফুফু। আকবর তাঁকে দায়িত্ব দেন হুমায়ুনের জীবনবৃত্তান্ত লেখার। তিনিও লিখেন তাঁর নিজের মত করে। হুমায়ুনকে নিয়ে তাঁর এ বর্ণনাই হুমায়ুননামা।

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৯-০৬ ২৩:০৬:৪০

 আপডেট: ২০১৫-০৯-০৬ ২৩:১৭:৪৪

ফরিদ আহমেদ:

পূর্ব প্রকাশের পর...
৭.পাগলা রাজা
হুমায়ুনের জীবনটা পাগলামি, আলস্য আর খামখেয়ালিতে পরিপূর্ণ। আফিমে বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি, করতেন উদ্ভট সব কাণ্ডকারখান, যা একজন বাদশাহের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ যেন এক পাগলা রাজা, সমস্ত নিয়মনীতিকে উলটে দিয়ে যিনি চলেন তাঁর একান্ত নিজস্ব নিয়ম এবং ইচ্ছা অনুসারে।

জ্যোতিষশাস্ত্রে হুমায়ুনের গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ফলিত জ্যোতিষের আলোচনায় অপরিসীম আনন্দ অনুভব করতেন। রাজদর্শনাভিলাষী ব্যক্তিদের অভ্যর্থনার জন্য সাতটি সুসজ্জিত কক্ষ করেছিলেনহুমায়ুন। সাতটা গ্রহের নামে এদের নামকরণ করেছিলেন তিনি। এই সকল কক্ষের গৃহসজ্জা, চিত্রাবলী এবং ভৃত্যদের পোশাকে সেই গ্রহের চিহ্ন আঁকা থাকতো। যে দিন যে গ্রহের প্রভাব বিদ্যমান থাকতো, সেদিন সেই গ্রহের নামানুসারে করা কক্ষে হুমায়ুন দরবার করতেন। রাজদর্শনাভিলাষী ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁর যে গুণের প্রাধান্য থাকতো, তাঁকে সেই গুণবিশিষ্ট গ্রহের নামে ডাকা কক্ষে উপস্থিত হতে হতো। কবি, পরিব্রাজক ও বিদেশী রাজদূত সোম কক্ষে, বিচারক, শাস্ত্রবেত্তা ও কার্য্যাধ্যক্ষরা বুধ কক্ষে এবং সৈনিক পুরুষেরা বৃহস্পতিকক্ষে রাজদর্শন করতেন।

হুমায়ুন রাজকার্য নির্বাহের জন্য চতুর্ভুতের নামানুসারে চারটি বিভাগ সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে আতসী, হাওয়াই, আবি ও খাকি। এই চার বিভাগের কাজ সম্পাদন করার জন্য চারজন মন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। যে সব দ্রব্য প্রস্তুত করার জন্য অগ্নির আবশ্যক হতো, যেমন নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্র এবং যন ত্র, সেগুলোর নির্মানকাজ আতসী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরিচ্ছদগৃহ, পাকশালা ও আস্তাবল, এগুলো হাওয়াই বিভাগের অধীন ছিল। সরবতখানা, সুজিখানা ও খাল, এগুলোর কাজ আবি বিভাগের তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত হতো। কৃষি, পূর্ত, খালসা ভূমি ও কোনো কোনো গৃহকাজের জন্য খাকি বিভাগের সৃষ্টি হয়েছিল।

এগুলোকে খামখেয়ালি বলে চালানো যেতে পারে। কিন্তু, এক ভিস্তিওলাকে নিয়ে হুমায়ুন যা করেছিলেন, সেই রকম পাগলামি ইতিহাসে বিরল। চৌসার যুদ্ধের সময় বিশ হাজার মোগল সৈন্য নদীতে ডুবে যায়, হুমায়ুনের ঘোড়া নিহত হয় এবং তিনি নিজে জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাঁতার না জানা এই বাদশাহকে এক ভিস্তিওলা তার মশকের সাহায্যে নদীর জলে ডুবে মরা থেকে বাঁচান। কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে এই ভিস্তিওলাকে তিনি দুই দিনের জন্য সত্যিকারভাবে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। গুলবদন এ বিষয়ে এভাবে বর্ণনা করেছেন।

“এই সময় একজন ভিস্তিকে (জলবাহক) সর্বদা বাদশাহের সঙ্গে দেখা যেত। এই ভিস্তি এক নিদারুণ বিপদের মুহুর্তে বাদশাহের প্রাণরক্ষা করেছিল। চুসা অঞ্চলের যুদ্ধে বাদশাহের ঘোড়া নিহত হয়, প্রাণ বাঁচাতে বাদশাহ গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। তখন এই ভিস্তি তার মশক দিয়ে বাদশাহকে রক্ষা করেছিল। চুসা অঞ্চলের যুদ্ধে বাদশাহের ঘোড়া নিহত হয়, প্রাণ বাঁচাতে বাদশাহ গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। তখন এই ভিস্তি তার মশক দিয়ে বাদশাহকে রক্ষা করেছিল। তার মশকের সাহায্য না পেলে বাদশাহ নদীতে হয়তো ডুবেই যেতেন। এই কাজের জন্য সন্তুষ্ট হয়ে বাদশাহ তাকে পুরস্কার স্বরূপ আগ্রার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এই ভিস্তিটির সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই আমি জানতাম না। কেউ কেউ তার নাম বলত নিজামাবার কেউ বলত সম্বল। হজরত বাদশাহের অমূল্যজীবন রক্ষার পুরস্কার হিসাবে সে সিংহাসনে বসার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছিল”।

এই সিংহাসনে বসানো যে শুধুমাত্র লোক দেখানো ছিল তা নয়, কিংবা তামাশাও নয়। ভিস্তিওয়ালা নিজামকে সত্যি সত্যি বাদশাহের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে গুলবদন বলেছেন,

“বাদশাহ দরবারের সমস্ত আমির ওমরাহদের বলে দিয়েছিলেন যে তাঁরা বাদশাহকে যেমন মর্যাদা দিয়ে সালাম জানান, কুর্নিশ করেন, ভিস্তি নিজাম যখন সিংহাসনে আসীন হবেন তখন তাকেও যেন অনুরূপভাবেই সম্মান দেখান। গোলাম নিজাম সিংহাসনে বসে খুব দান খয়রাত ও পদ প্রদান করে।“

স্ক্রাইন অবশ্য ভিস্তি নিজাম যে দুই দিন সিংহাসনে আসীন ছিলেন, এটা মানেন নি। তার মতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্থায়ীত্ব হয়েছিল এই ক্ষণিকের তরের বাদশাহি। তাঁর ভাষ্যে,

“এই ভিস্তিওয়ালা পুরস্কারপ্রার্থী হইয়া দিল্লীতে উপনীত হইলে হুমায়ুন তাহাকে বারো ঘণ্টার (কারো কারো মতে দুই ঘণ্টা) জন্য সিংহাসনে উপবিষ্ট করিয়ে পুরস্কৃত করেন। ভিস্তিওয়ালা এই অল্প সময়ের জন্য সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করে নিজের ও নিজের আত্মীয়স্বজনের ভরণপোষণের সুবন্দোবস্ত করে নিয়েছিল”।

হুমায়ুনের এই ছেলেমানুষি আচরণ পছন্দ করে নি তাঁর ভাইদের কেউই। যে দুইদিন ভিস্তিওলা নিজাম সিংহাসনে বসে ছিলেন, সেই দুই দিন মির্জা হিন্দোল দরবারে আসেন নি। সৈন্য সংগ্রহের কথা বলে আলোর চলে যান তিনি। মির্জা কামরানও দরবারে আসেন নি। তিনি অবশ্য অসুস্থ ছিলেন এমনিতেই। তবে, তার মনোভাবও মির্জা হিন্দোলের মতোই ছিল। ভিস্তিওলাকে সিংহাসনে বসানোটাকে একদমই মেনে নিতে পারেন নি তিনি। তিনি বাদশাহকে বলেছিলেন যে, লোকটি যত উপকারই করে থাকুক না কেন, তার জন্য তাকে সিংহাসনে বসানো উচিত হয় নি। তাকে অন্য কোনো পুরস্কার কিংবা জায়গির দেওয়া যেতো। বিশেষত, শের খান যখন ক্রমশই আগ্রার দিকে এগিয়ে আসছে তখনহুমায়ুনের এই সব বালসুলভ কাজকর্মের কোনো অর্থ হয় না বলে বিষয়টাকে সমালোচনা করেছিলেন তিনি।

আগামি পর্বে সমাপ্য... 

হুমায়ুননামা এবং একজন হেরেমবাসিনীর গল্প- প্রথম পর্বের URL:    http://www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/8040
হুমায়ুননামা এবং একজন হেরেমবাসিনীর গল্প- দ্বিতীয় পর্বের URL:  http://www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/8116
হুমায়ুননামা এবং একজন হেরেমবাসিনীর গল্প- তৃতীয় পর্বের URL:  http://www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/8253
হুমায়ুননামা এবং একজন হেরেমবাসিনীর গল্প- চতুর্থ পর্বের URL:   http://www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/8454

আপনার মন্তব্য