প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-১৯ ২৩:১৮:১৯
রেজা ঘটক:
না। সেদিন আমি হুমায়ূন আহমেদের লাশ দেখতে যাইনি। শহীদ মিনারের একেবারে পশ্চিমের দিকে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে হাজির ছিলাম মাত্র। ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি আমি মায়ের মৃত্যু মুহূর্তের পুরো সময়টা মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি। সেই থেকে আমি আর কোনো লাশের মুখ দেখি না।
কয়েকদিন আগে (রমজানের মধ্যে) আমার আনু ভাবী'র মা মারা যান। গল্পকার জেসমিন মুননী'র নানী। আমি উত্তরা গিয়েছিলাম, জানাজা পড়েছি, মাঐ সাহেবাকে দাফনও করেছি কিন্তু লাশের মুখ দেখিনি। মাঐ সাহেবার সেই হাসিমুখটাই আমার এখনো মনে আছে। ওটাই বাকি জীবন আমার স্মৃতিতে থাকবে। কারো লাশ দেখলে সেই ব্যক্তির শেষ মুহূর্তের সেই মুখই আমার বেশি মনে পড়ে। যা আমি এড়াতে পারি না। তাই লাশের মুখ দেখা আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই ছেড়ে দিয়েছি। এতে আমার স্মৃতিরা কখনো আমার সাথে বিট্রে করে না।
হুমায়ূন আহমেদের যে মুখটা আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সেটি হল সিগারেট টানছেন, হাসিমুখে গল্প করছেন আর আড্ডা মাতিয়ে রাখছেন। আড্ডাবাজ এক রাজপুত্তুরের চেহারাই আমার কেবল মনে পড়ে। তাই হুমায়ূন আহমেদের শেষ মুহূর্তের লাশের ছবি আমি ইচ্ছে করেই দেখিনি। লাশের ছবি দেখা যে কোনো জীবন্ত মানুষের জন্য ভারী কষ্টের। সেই কষ্ট ছাপিয়ে স্মৃতির মনিকোঠায় সেই লাশের ছবি একটা স্থায়ী দাগ কাটে। অন্যের বেলায় কি হয় জানি না। আমার বেলায় এটাই হয়। তাই আমার স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ মরেননি। হুমায়ূন আহমেদ এখনো জীবিত আছেন। হয়তো নুহাশ পল্লীতে কোনো কোনে বসে শুটিং ইউনিট নিয়ে আড্ডা মারছেন। বা এই বর্ষায় রাত জেগে জেগে কোথাও বসে জোছনা দেখছেন। তবে উনি যেখানেই থাকুন, বর্ষা আর জোছনা এ দুটো ছাড়া উনি বাঁচতে পারবেন না। এ আমি বাজি ধরে বলতে পারি।
বিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ — ১৯ জুলাই, ২০১২) অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নানাবাড়ি মোহনগঞ্জে (নেত্রকোনা জেলা) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যদিও স্কুল সার্টিফিকেটে তাঁর জন্ম তারিখ লেখা ১০ এপ্রিল ১৯৫০। কারণ, বাংলাদেশের স্কুল গুলোতে ক্লাস নাইনে ওঠার পর বোর্ডে নাম রেজিস্ট্রেশানের সময় এই অপরাধটি আমাদের স্কুলের মহামান্য শিক্ষকগণ নিজ দায়িত্বে করে থাকেন। তখন থেকেই আমাদের সবার অটোমেটিক দুটো জন্মদিন হয়ে যায়। একটি সত্যিকারের জন্ম দিন।
আরেকটি স্কুল প্রদত্ত সার্টিফিকেট জন্মদিন। যে কারণে মিথ্যা জন্মদিনটি নিয়ে বাংলাদেশের স্কুল পাস করা মানুষেরা বাকি জীবন মিথ্যার সঙ্গে বসবাস করে। আমি আমার সার্টিফিকেটগুলো নিজের হাতে পুড়িয়েছি। তারপর আসল জন্মদিন অনুসারে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও পাসপোর্ট করেছি। মিথ্যাকে পোড়াতে আমার বরং আনন্দই লেগেছে।
শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদকে জনপ্রিয় লেখক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। অমর একুশে বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টল থেকে হুমায়ূন আহমেদের বই কিনে অটোগ্রাফ নেবার জন্য যে লম্বা লাইন আমি দীর্ঘদিন দেখেছি, সে হিসাবে হুমায়ূন আহমেদ গোটা বাংলা সাহিত্যেরই জনপ্রিয় লেখক হলেও আমি আশ্চর্য হব না। কারণ নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না। অবশ্য রবীন্দ্রভক্তরা আমার এই কথা শুনলে নাক সিটকাতে পারেন। অতিমাত্রায় রবীন্দ্রভক্তদের আমার আইএসআইএসের মত মৌলবাদী মনে হয়। আমি নিজেও রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করি। রবীন্দ্রনাথের গান না শুনে আমি হয়তো একটি দিনও পার করিনা। কিন্তু সানজিদা খাতুনদের মত আমি মৌলবাদী রবীন্দ্রভক্ত নই।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। এছাড়া বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি একজন পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমান সমাদৃত। ২০১১ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীরও তিনি একজন পথিকৃৎ।
`নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্প, এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, মেঘ বলেছে যাব যাব, এফিটাফ, দেবী, বহুব্রীহি, বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেনপেন, কবি, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, কৃষ্ণপক্ষ, ১৯৭১, পাখি আমার একলা পাখি, অচিনপুর, আমার আছে জল, মধ্যান্থ, ময়ুরাক্ষী, দারুচিনি দ্বীপ, নক্ষত্রের রাত, জয়জয়ন্তি, মাতাল হাওয়া, দূরে কোথাও, নি, প্রিয়তমেষু, একা একা, পুতুল, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, সে আসে ধীরে, আগুনের পরশমনি, মহাপুরুষ, তারা তিনজন, শ্রাবণ মেঘের দিন' এমন অনেক জনপ্রিয় উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। `মিসির আলী আর হিমু' লজিক আর এন্টি লজিক নিয়ে তাঁর দুই বিখ্যাত চরিত্র। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কয়েকদিন ধরে জীবিত কিছু ক্যারেক্টার নিয়ে একটা ভূতের গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। অনেকেই জানে না যে ধ্রুব'দার (ধ্রুব এষ) বাসায় একটা আজগুবি ভূত থাকে। কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুরের ভাগ্নী বর্ষা বিভাবরী আমাকে সেই খবরটি প্রথম দেয়। ভূতটি নাকি খুব জেন্টেল আর ইনটেলিজেন্ট। খারাপ লোকদের ওই ভূতটা একদম সহ্য করতে পারে না। ধ্রুব'দার বাসায় বেশি লোকজনের ভিড় হলে ভূতটা ছাদের চিলেকোঠায় চলে যায়। এই ভূতের সঙ্গে জুবেরী ভাই, উত্তম দা, মাসুক ভাই (মাসুক হেলাল), শামীম ভাই (ইমতিয়ার শামীম), টোকন ঠাকুর, রুদ্রাক্ষ রহমান, ধ্রুব'দা আর আমারও খুব খাতির।
যদিও প্রকৃত জনশ্রুতি হল, হুমায়ূন আহমেদ একবার ধ্রুব'দার বাসায় গিয়েছিলেন ওঁনার বইয়ের প্রচ্ছদ করার জন্যে। সেদিন যে অমাবস্যা ছিল এটা হুমায়ূন আহমেদের একদম মনে ছিল না। ধ্রুব'দার সঙ্গে কথা শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কেউ একজন ওঁনাকে তখন ফলো করছিল। ধ্রুব'দার বাসার দক্ষিণ পাশের মরা পুকুরের পাড় পর্যন্ত ভূতটা তখন হেঁটে গিয়েছিল। আর উধাও হবার আগে হুমায়ূন আহমেদকে হিমু বলে নাকি পেছন থেকে ভেংচি কেটেছিল। তার কিছুদিন পর, অন্য এক পূর্ণিমার জোছনা ভরা রাতে হুমায়ূন আহমেদ আবার ধ্রুব'দার বাসা থেকে বের হবার সময় ওই মরা পুকুর পাড়েই প্রথম নাকি তাঁর হিমুকেও দেখেছিলেন।
মজার ব্যাপার হল, হুমায়ূন আহমেদের হিমুর সঙ্গে ওই ভূতটারও খুব খাতির। এই ঘটনা বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করার পর হুমায়ূন আহমেদ একসময় হিমু চরিত্র নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। সত্যমিথ্যা জানি না। আমিও শুনেছি এই ঘটনা।
আমার গল্পের ওই ভূতটা সম্পর্কে জুবেরী ভাই খুব মজার মজার তথ্য জানেন। তবে ধ্রুব'দার বাসার চিলেকোঠার আলো-আঁধারি রাতের জলসা ছাড়া সেই গল্প জুবেরী ভাই কখনো কাউকে করেন না। আমাদের বর্ষার কাছেও অনেক তথ্য আছে। কিন্তু ভূতটার সঙ্গে আবারো দেখা না হওয়া পর্যন্ত আমার গল্পটা আটকে আছে। এটাই হল বাস্তবতা। কোনো এক শীতকালে আমি ওই ভূতটা নিয়ে হয়তো বেশি বাড়াবাড়ি করেছিলাম। আর ধ্রুবদা'র বাসার ওই চিলেকোঠা থেকে নামার সময় হঠাৎ সিঁড়িতে কে যেনো আমাকে ডান্ডি মেরে একদম ধরাসাই করেছিল।
আমার সামনে তখন ছিলেন ধ্রুব'দা আর টোকন ঠাকুর। উত্তম'দা আর জুবেরী ভাই সেই রাতে অনেক আগেই চলে গিয়েছিলেন। আর ছাদের চিলেকোঠায় আমরা তিনজন অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা মারছিলাম। তখন চিলেকোঠা থেকে নামার সময় আমি ছিলাম সবার পেছনে। সেই সুযোগটি নিয়েছিল ওই ভূতটা। পরে একঘণ্টা ধরে টোকন ঠাকুর, ধ্রুব'দা আর জয়ীতা অনেক চেষ্টা তদবির করে আমার জ্ঞান ফিরিয়েছিল। সেই থেকে ওই ভূতটার কথা আমার এখনো খুব স্পষ্ট মনে আছে।
তবে ওই ভূতটার সঙ্গে হূমায়ূন আহমেদের হিমু'র কী সম্পর্ক আমি তা এখনো জানি না। আমি শুধু চেষ্টা করছি ভূতটার একটা কাল্পনিক ছবি দাঁড় করাতে। এখন হূমায়ূন আহমেদ এভাবে অকালে চলে যাওয়ায় আমার ওই লেখার কী হবে, আমি তাও জানি না। আমার ভূতের গল্পটা সেই থেকে অসমাপ্ত আকারে পড়ে আছে। কারণ, ওই লেখার সকল ক্যারেক্টার জীবিত। কেবল তিনজন মাত্র অদৃশ্য ছিল। ধ্রুব'দার বাসার ওই ভূতটা, হূমায়ূন আহমেদের মিসির আলী আর হিমু। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই হূমায়ূন আহমেদ হঠাৎ মারা যাবার পর ওই ভূতের সঙ্গে আমার আর কখনোই দেখা হয়নি, কিন্তু মুশকিল হল ভূতটার সঙ্গে দেখা না হলে আমার ওই গল্পটা আর আগায় না।
হূমায়ূন আহমেদের মিসির আলী'র সঙ্গে এই নিয়ে প্রায় রাতেই আমার তখন তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল। মিসির আলী কিছুতেই মানতে চান না যে, ওটা একটা সত্যিকারের ভূত। আর জুবেরী ভাই বা বর্ষার কথায় মিসির আলী কোনো পাত্তাই দিতে চায় না। এ বিষয়ে ধ্রুব'দাকে জিজ্ঞেস করলে কী কোনো জবাব পাওয়া যাবে? বিষয়টা নিয়ে মাসুক ভাই, শামীম ভাই আর টোকন ঠাকুরের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে। রুদ্রাক্ষ'র সঙ্গে এ নিয়ে সিডিউলও হয়েছিল। কিন্তু হারামজাদা আমেরিকা গিয়ে এখন লাটবাবুর মত ঘোরাঘুরি করছে। যাক ভূতের গল্পটা না হয় পরে লেখা যাবে। আবার হূমায়ূন আহমেদের প্রসঙ্গে আসি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হুমায়ূন আহমেদকে আটক করেছিল। সেনাক্যাম্পে আটক অবস্থায় তাঁকে অনেক নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালানো হয়েছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি তখন বেঁচে যান। ২০১১-এর সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর দেহে অন্ত্রীয় ক্যান্সার ধরা পড়ে। তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না-পড়ায় সহজে তাঁর চিকিৎসা সম্ভব হয়। কিন্তু ১৯ জুলাই ২০১২ হঠাৎ এই নন্দিত লেখক ক্যান্সার নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে (১০ডব্লিউ ৪৩ নম্বর বেডের রোগী) স্থানীয় সময় বেলা ১টা ২০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিট) মৃত্যুবরণ করেন।
অতুলনীয় জনপ্রিয়তা সত্বেও বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্তুর হুমায়ূন আহমেদ অনেকটা অন্তরাল জীবন-যাপন করতেন। লেখালেখি আর চিত্রনির্মাণের কাজে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতেন। দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। পরে লেখালেখিতে বেশি সময় দেওয়ার জন্য ১৯৯০ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের জানুয়ারিতে হুমায়ূন আহমেদকে (আমেরিকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায়) জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাসে সিনিয়র স্পেশাল অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেন।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার ও লেখক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার জন্মস্থান পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে তিনি কর্তব্যরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাবাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তিনিও সময় পেলে লেখালিখি করতেন আর তা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। বগুড়া থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থের নাম `দ্বীপ নেভা যার ঘরে'। হুমায়ূন আহমেদের মায়ের নাম আয়েশা আখতার খাতুন। আয়েসা ফয়েজ নামেই যাঁর বেশি পরিচিতি। তাঁর ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশান লেখক এবং সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রফেসর। ছোটভাই আহসান হাবীব (আমাদের প্রিয় শাহীন ভাই) জনপ্রিয় গদ্য কার্টুন উন্মাদ সম্পাদক ও পেইন্টার।
হুমায়ূন আহমেদের নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা নিজের নাম ফয়জুর রহমানের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রেখেছিলেন শামসুর রহমান। পরে তিনি আবার নাম পরিবর্তন করে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। ডাকনাম ছিল কাজল। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, `বাবা ছেলে-মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে খুব পছন্দ করতেন। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকাকালে আমার নাম ছিল বাচ্চু। আর ছোটভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল। আর ছোটবোন সুফিয়ার নাম ছিল শেফালি'।
বাবার পুলিশের বদলির চাকরির কারণে হুমায়ূন আহমেদ পড়াশুনা করেছেন সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর এবং বগুড়ার বিভিন্ন স্কুলে। ১৯৬৫ সালে তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। তখন তিনি রাজশাহী বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। এরপর এইচএসসিতে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বোর্ডর অধীনে এইচএসসি পাশ করেন। অর্থনীতিতে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও পরে তিনি ইচ্ছা পরিবর্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে ভর্তি হন। রসায়নে তিনি অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভাষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। তখন তিনি প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী `তোমাদের জন্য ভালোবাসা' লেখেন। পরে ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে একজন লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করার জন্য তিনি আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যান। দুই বছর সেখানে পিএইচডি করার পর আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে তিনি লেখালেখিতে বেশি মনোযোগ দেবার জন্য শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন।
১৯৭৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ বিয়ে করেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খানের নাতনী গুলকেতিনকে। তাঁদের তিন মেয়ে বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং এক ছেলে নুহাশ আহমেদ। তাঁদের একটি পুত্রসন্তান অবশ্য অকালে মারা যায়। ২০০৩ সালে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ২০০৫ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে। তাঁদের দুই ছেলে নিশাদ ও নিনিত। তাঁদের প্রথম কন্যাসন্তানও অকালে মারা যায়।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম টেলিভিশান নাটক `প্রথম প্রহর'। এটি পরিচালনা করেন নওয়াজেশ আলি খান। আর এটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ১৯৮৩ সালে। তারপর থেকে তাঁর নাটকে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তাঁর প্রথম টেলিভশান ধারাবাহিক `এই সব দিন রাত্রী'। এটি সর্বমহলে জনপ্রিয়তা পেলে তারপর আসে তাঁর জনপ্রিয় কৌতুক ধারাবাহিক `বহুব্রীহি'। তারপর আসে ঐতিহাসিক ধারাবাহিক `অয়োময়' এবং নাগরিক ধারাবাহিক `কোথাও কেউ নেই'। `কোথাও কেউ নেই'-এর `বাকের ভাই' একটি জনপ্রিয় চরিত্র। এরপর তিনি লেখেন সবচেয়ে জনপ্রিয় দীর্ঘ ধারাবাহিক `নক্ষত্রের রাত'।
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী অবলম্বনে হুমায়ূন আহমেদের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র `আগুনের পরশমনি'। এটিতে তিনি চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। এটিতে তিনি সেরা পরিচালক ও সেরা ছায়াছবি পুরস্কার সহ আটটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পান। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী অবলম্বনে হুমায়ূন আহমেদের পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র `শ্যামল ছায়া'। এটি অস্কার পুরস্কারের বিদেশী ভাষার ফিল্মের জন্য বাংলাদেশ থেকে নমিনেশান পায়। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো হল: `শঙ্খনীল কারাগার', `আগুনের পরশমনি', `শ্রাবণ মেঘের দিন', `দুই দুয়ারী', `চন্দ্রকথা', `নয় নম্বর বিপদ সংকেত', `আমার আছে জল', `নিরন্তর', `প্রিয়তমেষু', `দারুচিনি দ্বীপ', `শ্যামল ছায়া' ও `ঘেটুপুত্র কমলা'। এরমধ্যে ২০১২ সালে ৮৫তম অস্কার পুরস্কারের বিদেশী ভাষার ফিল্মের জন্য বাংলাদেশ থেকে নমিনেশান পায় তাঁর `ঘেটুপুত্র কমলা'।
`নন্দিত নরকে'-এর জন্য হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে পান `লেখক শিবির পুরস্কার'। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে পান শিশু একাডেমী পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে পান জয়নুল আবেদীন গোল্ড মেডেল। ১৯৮৭ সালে পান মাইকেল মধুসূদন পদক। ১৯৮৮ সালে পান বাকসাস পুরস্কার। ১৯৯০ সালে পান হুমায়ুন কাদের স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৯৪ সালে পান একুশে পদক এবং ২০০৭ সালে পান সেলটেক পদক।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নাকি চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ কোনটা তাঁর বড় পরিচয়? দুটো শাখায় তিনি সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পারিবারিক জীবনের কিছু অঘটন থাকলেও সারা জীবন হুমায়ূন আহমেদ রাজপুত্তুরের মতো জীবনযাপন করেছেন। আজ হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান গদ্যশিল্পীকে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আপনার মন্তব্য