ষাটের ভেলায় মোহিত!

 প্রকাশিত: ২০১৯-০১-০২ ২২:৫৯:২৪

অপূর্ব শর্মা:

আমাদের কথাসাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে মোটা দাগে একটি অভিযোগ আছে-‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ নিয়ে তারা খুব একটা লিখেন না। হয় অতীত না হয় কল্পনার সাগর সাতরে বেড়ান তারা। সত্যিই কি তাই? এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি দাঁড় করানো যাবে। কিন্তু হচ্ছে না এ কথাটা ঠিক নয়; অবশ্যই হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে তুলনামূলক বেশিই হচ্ছে। তরুণ লেখকদের পাশাপাশি প্রথম সারির লেখকরাও এখন বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমসাময়িক ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় আনছেন। মোহিত কামাল তাদেরই একজন। পেশাদারিত্বে যেমন সাহিত্যচর্চায়ও তেমনই অনন্যতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মনোরোগ সারাতে তিনি যেমন বদ্ধপরিকর তেমনই মানুষের মননভূমিকে রাঙাতেও মোহিত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিজস্বতার আখ্যানে ভাস্মও তাঁর লেখনবিশ্ব। যাপিতজীবনের কতকথায় তিনি বহুবর্নিল করে চলেছেন কথাসাহিত্যের ক্যানভাস। সস্তা জনপ্রিয়তার অভিষ্পা তাঁকে লক্ষ্য থেকে কখনও বিচ্যুৎ করতে পারেনি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি সাম্প্রতিকতা নিয়ে লিখে চলেছেন। তাঁর সৃজনকর্ম শুধু নান্দনিকতার বিভাই ছড়াচ্ছে না, সাহিত্যে যুক্ত করছে ভিন্নমাত্রা। এর মাধ্যমে সামাজিক অসুস্থতা নিরাময়ের দাবিটি তিনি উত্থাপন করছেন জোরালোভাবে। যা আমাদেরকে নিজ দায়বোধের প্রতি যতœশীল হওয়ারও নির্দেশনা দিচ্ছে। পথ দেখাচ্ছে সুন্দরের। চিন্তার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করতেও সাহায্য করছে। মানুষের সঙ্গে সৃজনকর্মের এইযে সংযুক্তি, সেটাই একজন মোহিত কামালকে অন্যদের চাইতে আলাদা করে চেনাতে সাহায্য করছে পাঠকদের। যা তাকেও সমৃদ্ধির পাকাপোক্ত আসনে আসীন হওয়ার পথে অগ্রসর করছে ক্রমশ।
 
পরিবেশ, পরিপার্শ্ব এবং অভিজ্ঞতা একজন লেখককে শীর্ষে আরোহনে সাহায্য করে। মোহিত কামালের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছে সেটা। জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ, তাঁর শিশুমনে প্রোথিত করেছিলো সাহিত্যের বীজ। সেটাই কালক্রমে সুশোভিত হয়েছে। সেই অভিযাত্রাকে লক্ষ্যে পৌছতে যেমন নিজ প্রচেষ্টা ছিলো তেমনই প্রেরণা ছিলো একাধিক শিক্ষাগুরুর। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের বাংলার শিক্ষক আলী আকবর তাঁর লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘একদিন লেখক হতে পারবি তুই।’ শিক্ষকের সেই প্রেরণা বাংলার প্রতি অধিক আগ্রহী করে তোলে তাঁকে। এরই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায়। এই পরীক্ষায় বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর  পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাংলার অধ্যাপক সিরাজউদ্দৌলা বলেছিলেন, ‘তোমার  লেখার হাত খুব ভালো, আমি বিশ্বাস করি এ পথে এগিয়ে গেলে একদিন লেখক হতে পারবে তুমি।’ এই দুই শিক্ষকের দেখানো স্বপ্নের পথ ধরেই লিখতে শুরু করেন মোহিত কামাল। এক সময় উদ্যোগ নেন লেখা প্রকাশের। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় যায়যায়দিনের বিশেষ সাহিত্য আয়োজন ‘মৌচাকে ঢিল’-এর প্রথম সংখ্যায়। ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর সেরাগল্প হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর এই গল্পটি। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। গল্প প্রকাশের দুই বছর পর বের হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ কাছের তুমি দূরের তুমি। ১৯৯৫ সালের বইমেলায় গ্রন্থটি প্রকাশ করে সময় প্রকাশন। এরপর থেকে নিয়মিতই গ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে তাঁর। এ পর্যন্ত ৪৭ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৭ উপন্যাস, ১০ গল্পগ্রন্থ এবং ১০ শিশুসাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থের ¯্রষ্টা তিনি।

গল্প উপন্যাস আর শিশুসাহিত্যের পাশাপাশি প্রবন্ধ-নিবন্ধে নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন মোহিত কামাল। সহজকথায় সাবলীলভাবে লেখা তাঁর গল্প উপন্যাসগুলো পড়লে মনে হবে, গতদিনের ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি আমরা, যা ছবির মতো ভেসে উঠে আমাদের চোখের সামনে। একজন কথাসাহিত্যিকের লেখা যখন পাঠককে আবিষ্ট করে তখনই তাঁকে সফল বলা যায়। বর্ণিত চরিত্রটিকে যে লেখক যত বেশি জীবন্ত করে তুলতে পারেন তিনিই তত বেশি সফলকাম হন। মোহিত কামালের সৃজনবিশ্ব পরিভ্রমন করলে অনায়াসেই তাঁকে সেই দলে ফেলা যায়। লেখক হিসেবে এখানেই মোহিত কামালের সার্থকতা। শুধু চিকিৎসা এবং লেখালেখিতেই নয়, নিরলসভাবে সমাজসেবামূলক নানা কর্মকা-ের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন তিনি। মাদক বিরোধী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আছে সর্বত্র। তরুন প্রজন্ম যেনও বিপথগামী না হয় সেজন্য দীর্ঘদিন ধরেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তারুণ্যের সাহিত্য বিকাশেও পালন করে চলেছেন অনন্য ভূমিকা। সাহিত্য পত্রিকা শব্দঘর প্রকাশ করে নবীন প্রবীনকে যেমন এক প্লাটফর্মে নিয়ে এসেছেন তেমনই নবীনদের মেধা বিকাশের পথকে সুগম করতে শুরু করেছেন ‘শব্দঘর-অন্যপ্রকাশ কথাশিল্পী অন্বেষন’। এই প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত প্রথম সেরা উপন্যাস প্রকাশ করে তরুন লেখকদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আত্মহত্যা রোধে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহন করে অসংখ্য মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন মোহিত কামাল। নিজ প্রভায় তিনি আলোকিত করে চলেছেন এক বৃহত্তর পরিমন্ডলকে। অন্ধকারের অতলে যেন নিমজ্জিত না হয় মানুষ সেটাই তাঁর প্রত্যয়। তবে, পেশাদারিত্ব এবং সৃজনশীলতা-এই দু’টোকে কখনও গুলিয়ে ফেলেন না তিনি। অত্যন্ত দক্ষতায়, গভীর নিষ্ঠায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজের সর্বোচ্চটা দিতে কোনও কার্পণ্য করেন না। প্রতিদিনের সময়কে ভাগ করে কর্মজীবন ও সাহিত্য জীবনকে আলাদা করে প্রবহমান রেখেছেন জীবন তরী। সে কারনেই লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলা তাঁর নৌকাটি দিকভ্রান্ত হয়নি আজ পর্যন্ত।

সৃজনকর্মের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (২০১৪) উপন্যাসের জন্য সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪), কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক গ্রন্থের জন্য এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২) এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৪১৮) বঙ্গাব্দ লাভ করেছেন তিনি। এছাড়াও এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮, বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮, স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫, ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬ প্রাপ্তি তাঁর অর্জনের ভা-ারকে করেছে সমৃদ্ধ।

১৯৬০ সালের ২ জানুয়ারি আসাদুল হক-মাসুদা খাতুন দম্পত্তির চতুর্থ সন্তান হিসেবে ভূমিষ্ট হওয়া মোহিত কামাল আজ ষাটের ভেলায় ভাসাবেন তাঁর জীবনের তরী। জীবনের ছয়টি দশক অতিক্রান্তের এই লগ্নে তাঁর প্রতি রইলো আমাদের অশেষ ভালোবাসা। মানবসেবা, মনোচিকিৎসা এবং লেখালেখিসহ তাঁর বিচররণের প্রতিটি ক্ষেত্রই সমৃদ্ধির আখ্যানে ভরপুর হয়ে উঠুক, জন্মদিনের দিনে এই কামনা।

আপনার মন্তব্য