বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব: আত্মা এবং শরীর

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২০ ০২:০৩:৪২

কাজী মাহবুব হাসান:

[প্রথম পর্বের পর...]

লেখকের পক্ষে পাঠকদের মনে এমন কোনো বিশ্বাস জন্মানোর প্রচেষ্টা অর্থহীন যে, তার চরিত্রগুলো আসলেই কোনো একসময় বেঁচে ছিল। কোনো মাতৃগর্ভে জন্ম হয়নি তাদের, তাদের জন্ম হয়েছে একটি কিংবা দুটি উদ্দীপক বাক্য বা কোনো একটি সাধারণ মৌলিক পরিস্থিতি থেকে। টমাসের জন্ম হয়েছে ‘আইনমাল ! ইস্ট কাইনমাল’ (Einmal ist keinmal’) [১], এই প্রবাদ বাক্যটি থেকে।তেরেজার জন্ম হয়েছে পেটের একটি গুড়গুড় শব্দ থেকে।

প্রথম বারের মত যখন তেরেজা টমাসের ফ্ল্যাটে এসেছিল,হঠাৎ করেই তার পেটের ভেতরে গুড়গুড় করে শব্দ শুরু হয়েছিল; আর এমন হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু ছিল না, কারণ সেই সকালের খাবারের পর সে আর কিছু খায়নি।ট্রেনে উঠে বসার আগে প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে শুধু একটা স্যান্ডউইচ খেয়েছিল । তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে ছিল ভবিষ্যতের দিকে তার এই দুঃসাহসী যাত্রার কথা, খাওয়ার কথা মনেই ছিল না তার। কিন্তু যখন আমরা আমাদের শরীরকে উপেক্ষা করি, আরো সহজেই তাদের শিকারে পরিণত হই আমরা।

খুবই খারাপ লাগছিল তেরেজার, পেটের মধ্যে এই অস্বস্তিকর শব্দ নিয়ে টমাসের সামনে দাড়িয়ে থাকতে। মনে হচ্ছিল তখনই সে কেঁদে ফেলবে। সৌভাগ্যজনকভাবে, প্রথম দশ সেকেন্ড পরই টমাস তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল, এবং তেরেজাকে তার শরীরের গভীর থেকে আসা বিব্রতকর শব্দগুলোর কথা ভুলিয়ে দেয়।


সুতরাং তেরেজার জন্ম হয়েছে  এমন একটি পরিস্থিতি থেকে, যা খুব নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশ করে শরীর এবং আত্মার অসমন্বয়যোগ্য দ্বৈততাটিকে, সেই মৌলিক মানবিক অভিজ্ঞতাটি।

বহুদিন আগে, মানুষ বিস্ময়ের সাথে তার বুকের ভিতর ছন্দময় স্পন্দনের শব্দ শুনতে পেত, কখনো বুঝতে পারেনি শব্দগুলো আসলে কি। শরীরের মত অনাত্মীয় আর অচেনা একটি জিনিসের সাথে মানুষ পারেনি নিজেকে একাত্ম করে ভাবতে। শরীরটা ছিল যেন একটি খাঁচার মত, আর সেই খাঁচার ভিতরে ছিল কিছু একটা জিনিস, যা দেখতো, শুনতো, ভয় পেতো, ভাবতো এবং বিস্মিত হতো, সেই কিছু বিষয়টি হলো -যা রয়ে যায় শরীরের সব হিসাব নিকাশ শেষ হলে – আত্মা।

আজ অবশ্য, আমাদের শরীর আর অচেনা কিছু নয়: আমরা জানি আমাদের বুকের মধ্যে ছন্দময় স্পন্দন আসলে হৃৎপিণ্ড, নাক হচ্ছে একটা পাইপের মুখ যা শরীরের বাইরের দিকে বের হয়ে থাকে,ফুসফুসে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যাবার জন্য। আমাদের চেহারা আর কিছুই না, শুধু একটা ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল, যা শরীরের নানা কর্মকাণ্ড কেমন চলছে তা জানান দেয়: পরিপাক,দৃষ্টি, শ্রবণ ক্ষমতা, শ্বাস, চিন্তা।

যেদিন থেকেই মানুষ তার শরীরের নানা অংশকে নাম দিতে শিখেছে, শরীর তাকে কম সমস্যায় ফেলেছে। মানুষ এটাও জেনেছে, আত্মা আসলে  তার মস্তিষ্কের কর্মরত গ্রে ম্যাটার ছাড়া আর কিছু না। শরীর এবং আত্মার প্রাচীন দ্বৈততা এখন ঢাকা পড়ে গেছে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এবং  হাসতেও পারি আমরা একে শুধুমাত্র সেকেলে একটি কুসংস্কার মনে করে।

কিন্তু শুধু প্রেমে পড়েছে এমন কাউকে তার পেটের গুড়গুড় শব্দ শোনানো হোক, আত্মা এবং শরীরের একাত্মতা, বিজ্ঞানের যুগে সেই কাব্যিক মায়াময়তা সাথে সাথেই ম্লান হয়ে যায়।


তেরেজা নিজেকে তার শরীর দিয়েই দেখার চেষ্টা করতো। একারণই, কৈশোর থেকেই সে বার বার আয়নার সামনে দাঁড়াতো, এবং যেহেতু ভয় ছিল তার মা এভাবে আয়নায় উকি মারাটা দেখে ফেলতে পারে, সেকারণই প্রতিবার আয়নায় চোখ রাখার কাজটায় মিশ্রিত ছিল গোপনীয় কোনো পাপ।

কোনো অহংকার কিন্তু তাকে আয়নার সামনে টানেনি; তেরেজা কাছে নিজের ’আমিকে’ দেখারই তীব্র বিস্ময় আর আনন্দ ছিল মুখ্য। সে ভুলে যেত, সে শুধু তার শরীরের নানা যন্ত্রের ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলটির দিকে তাকিয়ে আছে মাত্র; সে ভাবতো তার মুখায়ববের মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল আলো হয়ে বেরিয়ে আসা তার আত্মাকে যেন দেখছে। সে ভুলে যেত, নাক হচ্ছে সেই পাইপের মুখ যা অক্সিজেন নিয়ে যায় ফুসফুসে। সে দেখতো তার নিজস্ব প্রকৃতির নিখুঁত এবং সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি।

অনেক দীর্ঘ সময় ধরেই আয়নায় নিজেকে দেখতো তেরেজা, মাঝে মাঝে বিচলিত হত সে, চেহারায় তার মায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলোকে সরিয়ে দেবার ইচ্ছায় এবং শুধু তার নিজের টুকু ধরে রাখার চেষ্টায় সে আরো বেশী গভীর মনোযোগ দিয়ে তার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতো। আর যখনই সফল হতো, অদ্ভুত এক আনন্দের মত্ততা অনুভব করতো তেরেজা সেই সময়: তার শরীরের ভিতর থেকে উঠে আসতো তার আত্মা, যেমন করে কোন জাহাজের গভীর থেকে দল বেধে বের হয়ে আসে নাবিকরা, ছড়িয়ে পরে ডেকের উপর, আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ায় আর বিজয়ের আনন্দ উল্লাসে গান গায়।

টীকা: [১] Einmal ist keinmal:  একটি জার্মান প্রবাদ, যার  ইংরেজি অর্থ হতে পারে Once is never - আক্ষরিকার্থে একবার মানে কখনোই না। সাধারণত প্রবাদটি ব্যবহৃত হয় বোঝাতে একটি ঘটনা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ না বা কাউকে ক্ষমা করা যেতে পারে প্রথম বারের মত যদি কেউ ভুল করে ( এবং পরোক্ষভাবে দ্বিতীয়বার না)। কুন্দেরা তারThe Unbearable Lightness of Being উপন্যাসটিতে এটি ব্যবহার করেছেন একটু ভিন্ন বাড়তি অর্থ নিয়ে - আমরা যদি একটি মাত্র জীবন পাই বাঁচার জন্য, সেই বেঁচে থাকাটা না বেঁচে থাকার মতই, হয়তো আমরা আদৌ বেঁচে ছিলাম না।

[চলবে...]

আপনার মন্তব্য